স্বাস্থ্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৪১ শতাংশ ঢাকায়

দেশে ভারসাম্যহীনভাবে স্বাস্থ্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। সিংহভাগ প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিভাগেই কেন্দ্রীভূত। খুলনা বিভাগে সরকারি বা বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ নেই, এমনকি ডেন্টাল ইউনিটও নেই। অন্যদিকে ময়মনসিংহ বিভাগে কোনো স্বাস্থ্য কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেনি সরকার।

‘ম্যাপিং অব হেলথ প্রফেশনাল এডুকেশন ইনস্টিটিউশন ইন বাংলাদেশ’ (স্বাস্থ্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানচিত্র) নামের প্রতিবেদনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই তথ্য দিয়েছে। ঢাকা বিভাগে আর নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে না তোলার সুপারিশ করেছে জাতিসংঘের স্বাস্থ্যবিষয়ক বিশেষায়িত এই সংস্থা। গত এপ্রিল মাসে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে। দেশের স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভৌগোলিক অবস্থান, ডিগ্রি প্রদানের ধরনসহ নানা তথ্য আছে এই প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদন বলছে, ১৯৭১ সালে দেশে স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল মাত্র ২২টি। এর মধ্যে মেডিকেল কলেজ ৬টি, ডেন্টাল ইউনিট ১টি, মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্স ট্রেনিং স্কুল (ম্যাটস) ২টি, নার্সিং কলেজ ৫টি ও নার্সিং ইনস্টিটিউট ৮টি। স্বাধীন দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপক প্রসার ঘটে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ ৪৫ বছরে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩১ গুণ বেড়েছে।

কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এই বৃদ্ধি দেশের সব অঞ্চলের জন্য সমান হয়নি। ৬৭৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৮৯টি বা ৪১ শতাংশ ঢাকা বিভাগে। অন্যদিকে বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে কম, মাত্র ২৪টি বা মোট প্রতিষ্ঠানের মাত্র ৪ শতাংশ।

আবার দেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও একই চিত্র রয়েছে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ বর্তমানে ৬৯টি। এর মধ্যে ৩০টি ঢাকা মহানগর এলাকায়। ১২টি সরকারি অনুমোদন পেয়েছে ২০১০ সালের পর, অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর। অথচ বরিশাল বিভাগে একটিও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ নেই।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মেধা ও ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেকে ঢাকায় পড়তে আসেন না। অনেকের আর্থিক সামর্থ্য থাকে না। অনেকে ঢাকায় থাকার স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। অন্যদিকে ঢাকার বাইরে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে প্রান্তিক এলাকার মেধাবী ও অসচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েরা সেখানে পড়তে পারেন। সেই প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ওই অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা আরও সহজলভ্য হয়।

এই প্রতিবেদনকে গুরুত্বপূর্ণ বলেছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব (স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ) মো. আসাদুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঐতিহাসিকভাবে বা গতানুগতিকভাবে প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার কারণে পরিস্থিতি কিছুটা ভারসাম্যহীন হয়েছে। তবে সরকারের নীতি হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্যশিক্ষা বিকেন্দ্রীকরণ। প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি বিভাগে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিটি জেলায় মেডিকেল কলেজ করার ঘোষণা দিয়েছেন। সরকারের গৃহীত পদক্ষেপে ক্রমান্বয়ে এই ভারসাম্যহীন পরিস্থিতি দূর হবে।

খুলনায় দাঁতের প্রতিষ্ঠান নেই
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে ডেন্টাল কলেজ ও ডেন্টাল ইউনিটের সংখ্যা ৩৫টি। সরকারি ডেন্টাল কলেজ ১টি ও ৮টি মেডিকেল কলেজে ১টি করে ৮টি ডেন্টাল ইউনিট আছে। বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ ১৩টি। আর ১৩টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ১৩টি ডেন্টাল ইউনিট আছে।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিট থেকে বিডিএস (ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জারি) পাস করে এখন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ডেন্টাল ইউনিটে সহকারী অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করছেন আতিকুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এমবিবিএস ও বিডিএস কোর্সের শিক্ষার্থীদের কিছু সাধারণ বিষয়ে লেখাপড়া করতে হয়। সে কারণে মেডিকেল কলেজে পৃথক ইউনিট খুলে শিক্ষার্থীদের দন্ত চিকিৎসায় শিক্ষা দেওয়া হয়। ডেন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠায় খরচ অনেক বেশি।

বিডিএস কোর্স পাঁচ বছরের এবং এক বছরের ইন্টার্নশিপ। উচ্চমাধ্যমিক পাস করে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিডিএস কোর্সে ভর্তি হতে হয়।

>

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন
প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে আঞ্চলিক বৈষম্য তৈরি হয়েছে
খুলনা বিভাগে দন্ত চিকিৎসাশিক্ষার প্রতিষ্ঠান নেই

খুলনা বিভাগে মোট স্বাস্থ্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে ৫৫টি। এর মধ্যে সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ৯টি। কিন্তু কোনো মেডিকেল কলেজে ডেন্টাল ইউনিট নেই। এই বিভাগে কোনো ডেন্টাল কলেজও নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বিভাগে কেন একটিও ডেন্টাল কলেজ বা ডেন্টাল ইউনিট নেই, তা খতিয়ে দেখা দরকার।

এ ব্যাপারে খুলনা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল আহাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘খুলনায় দন্ত চিকিৎসাশিক্ষার ব্যবস্থা না থাকাটা খুবই দুঃখজনক। খুলনা মেডিকেল কলেজে একটি ইউনিট খোলার বা পৃথক ডেন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠার দাবি আমাদের দীর্ঘদিনের। কিন্তু সেই দাবি পূরণ হচ্ছে না।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকা বিভাগে কেন্দ্রীভূত। ঢাকা বিভাগে নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা দরকার। অন্য বিভাগে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে স্বাস্থ্যশিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে ন্যায্যতা নিশ্চিত করা দরকার।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক মহাসচিব রশীদ-ই-মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, আগ্রহ ও যোগ্যতা থাকলেও আর্থিকভাবে সচ্ছল না হওয়ার কারণে বরিশাল বা খুলনার অনেক শিক্ষার্থী মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্স ট্রেনিং স্কুল বা ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজিতে পড়তে ঢাকায় আসবেন না। আবার ঢাকার অনেক প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত শিক্ষার্থীও নেই। তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উন্নয়ন তথা স্বাস্থ্য খাতের বৈষম্যের বিষয়টি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা বিভাগের দুর্বলতা এতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তাঁর মতে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত এই প্রতিবেদনকে গুরুত্ব দেওয়া। আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করতে প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে তাঁদের পরামর্শ করতে হবে।

বাংলাদেশের উন্নয়ন, অর্থনীতি, প্রশাসন প্রায় সবকিছুই ঢাকাকে কেন্দ্র করে। এটা ক্ষমতা ও উন্নয়নের অতিকেন্দ্রিকতারই বহিঃপ্রকাশ। এই প্রবণতা সুষম উন্নয়ন ধারণার পথে বাধা। ঢাকা উন্নয়ন, বিনিয়োগ, অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় দেশের বহু অঞ্চল বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, উন্নয়নের ছোঁয়া লাগছে না সেখানে।

অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, এখন কথা হয় ঢাকা ও বাদবাকি বাংলাদেশ নিয়ে। রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতার কেন্দ্র ঢাকা। অবশিষ্ট বাংলাদেশ এর বাইরে। স্বাস্থ্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সমন্বয়হীনতা। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সমন্বয় থাকলে কোনো অঞ্চলে একটিও ডেন্টাল কলেজ বা ইউনিট থাকবে না, এটা হতে পারে না। এই অতিকেন্দ্রিকতা কমানোর পাশাপাশি কাজে সমন্বয় বাড়ালে সুষম উন্নয়ন সম্ভব হবে। সে ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যে ও শিক্ষায়ও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।