উল্টো ভুবনের চমক

ব্যতিক্রমী স্থাপত্যশৈলী ও আসবাবের বিন্যাসে সাজানো হয়েছে লালমাটিয়ার ‘আপসাইড ডাউন হাউস’। দর্শনার্থীরা সব কিছুই উল্টো করে দেখার মজার অভিজ্ঞতা পান। সাবরিনা ইয়াসমীন
ব্যতিক্রমী স্থাপত্যশৈলী ও আসবাবের বিন্যাসে সাজানো হয়েছে লালমাটিয়ার ‘আপসাইড ডাউন হাউস’। দর্শনার্থীরা সব কিছুই উল্টো করে দেখার মজার অভিজ্ঞতা পান। সাবরিনা ইয়াসমীন

এ যেন বিভ্রমের জগৎ। মজারও বটে। সাতটি সুপরিসর কক্ষে থাকা নানান আসবাব ছাদ থেকে উল্টো হয়ে ঝুলছে। কক্ষগুলোর স্থাপত্যশৈলী ও আসবাবের অবস্থান এমনই অদ্ভুত যে কায়দা করে এগুলোর সঙ্গে তোলা ছবি উল্টো করে ধরলেই মনে হবে লোকজন যেন হাওয়ায় ভাসছে।

এমন ব্যতিক্রমী অন্দরসজ্জা নিয়ে লালমাটিয়ায় যাত্রা শুরু করেছে ‘আপসাইড ডাউন হাউস’। অবস্থান লালমাটিয়ার সি ব্লকে, মিনার মসজিদের পূর্ব পাশে ২/৬ নম্বর ভবনের নিচতলায়। বৃহস্পতিবার বিকেলে অদ্ভুত সজ্জার এই বাড়িতে ঢুকেই যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ‘মজার দেশ’ ছড়াটি মনে পড়ে যায়। সেখানে ছড়াকার যে চিত্রকল্প এঁকেছেন, তার সবকিছুই ছিল প্রচলিত নিয়মের উল্টো। প্রথম কক্ষটি একইভাবে বসার কক্ষের আদলে সাজানো। চোখে পড়ল বসার চেয়ার, দাবার বোর্ড ও টেলিভিশন থেকে শুরু করে বইয়ের তাক—সবকিছুই উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা।

বসার কক্ষ পেরিয়ে সামনে যেতেই শৌচাগার, শোবার ঘর, রান্নাঘর, শিশুদের খেলার কক্ষ ও অফিস কক্ষ সাজানোর আদলটাও একই রকম। সব কটি কক্ষে প্রচলিত আসবাবসহ ঘর সাজানোর উপকরণগুলোও উল্টো করে ঝোলানো। এর সঙ্গে আছে নজরকাড়া আলোকসজ্জা। প্রতিটি কক্ষের আসবাবের সঙ্গে বিশেষ ভঙ্গিতে তোলা স্বাভাবিক ছবি উল্টো করে ধরতেই পাওয়া গেল আসল মজা। বোঝা গেল, উল্টো করে ধরা এই ছবিই তৈরি করছে বিভ্রম। মনে হচ্ছে ছবির লোকগুলো ভেসে আছে। ঠিক যেমন মহাকাশে ভেসে থাকে সব। পাশাপাশি ‘তান্ত্রিক ঘর’ নামের আরেকটি কক্ষে চোখে পড়ল চমৎকার দেয়ালচিত্র। শূন্যের ওপর বসে থাকা বা শোয়ার ছবি তোলার জন্য তৈরি করা হয়েছে ঘরটি।

মহাকাশ নিয়ে পর্যটকদের সত্যিকারের ‘জিরো গ্র্যাভিটি’ বা ওজনহীনতার অভিজ্ঞতা দিতে সম্প্রতি মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (নাসা) উদ্যোগ নিয়েছে। তা অবশ্য কঠিন ও প্রচণ্ড ব্যয়সাপেক্ষ। তবে অনেকটা মজার ছলে ওজনহীনতার বিরল এই অভিজ্ঞতার কাছাকাছি অনুভূতি দেওয়ার জন্য লালমাটিয়ায় ঢাকার চার তরুণের এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। পরিবার, প্রিয়জন নিয়ে অনেকে সেখানে যাচ্ছেন। তাঁদের তোলা অদ্ভুত ছবিগুলো ঘুরছে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

>

লালমাটিয়ায় যাত্রা শুরু করেছে ‘আপসাইড ডাউন হাউস’
বসার চেয়ার, দাবার বোর্ড, টেলিভিশন সবকিছুই উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা
ছবি তুললে মনে হয় মানুগুলো উল্টো হয়ে ভাসছে

তিন হাজার বর্গফুটের বেশি আয়তনের এই ‘ইলিউশনাল আর্ট গ্যালারি’ সাজানো হয়েছে ভিন্ন স্বাদ দেওয়ার জন্য। এই গ্যালারি প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা চার তরুণ হচ্ছেন আবদুল্লাহ আল মাহবুব, শাফি আহমেদ, ইশতিয়াক মাহমুদ ও আসিফুর রহমান। তাঁরা জানালেন, বছর দুয়েক আগে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে ঘুরতে গিয়ে এ ধরনের গ্যালারির সঙ্গে প্রথমবারের মতো পরিচয় হয় তাঁদের। অন্যতম উদ্যোক্তা আবদুল্লাহ আল মাহবুব বললেন, ‘আমরা খেয়াল করে দেখলাম, বর্তমানে ঢাকার মানুষের প্রধান বিনোদন বিভিন্ন রেস্তোরাঁকেন্দ্রিক। এর বাইরে তেমন কিছু নেই। এ ক্ষেত্রে মানুষকে অভিনব কিছুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই এই আয়োজন।’ আরেক উদ্যোক্তা ইশতিয়াক মাহমুদ বলেন, ‘এই গ্যালারিতে আমরা বিভ্রম তৈরি করছি নানান স্থাপত্য কৌশল প্রয়োগ করে। ভবিষ্যতে এ জন্য প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিকল্পনাও আছে।’

তবে ধারণাটি বাস্তবে রূপ দেওয়া খুব একটা সহজ ছিল না। গ্যালারির অন্দরসজ্জার বিষয়ে বিভিন্ন স্থাপত্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেও উদ্যোক্তারা তেমন কোনো সাহায্য পাননি। অনেকে তাঁদের এই উদ্যোগকে অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল গ্যালারির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ঝুলে থাকা আসবাবগুলো যাতে খুলে পড়ে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে, সে লক্ষ্যে তিন স্তরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে।

শাফি আহমেদের কাছ থেকে জানা গেল, ১৭ মে গ্যালারি চালুর শুরু থেকেই তাঁরা দারুণ সাড়া পাচ্ছেন। দর্শনার্থীদের গ্যালারি ঘুরিয়ে দেখানো এবং ছবি তোলার কাজে সহযোগিতার জন্য সাতজন লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা প্রত্যেকে পেশাদার আলোকচিত্রী। দর্শনার্থীদের ছবি তোলার বিভিন্ন ভঙ্গি দেখিয়ে দেন তাঁরা।

কথা হলো তিন শিশুকে নিয়ে গ্যালারি ঘুরতে আসা মোহাম্মদ নুরুল ইসলামের সঙ্গে। পেশায় মেরিন পাইলট এই বিমোহিত দর্শনার্থী বললেন, ‘এই গ্যালারির বিপরীত পাশেই আমার বাসা। প্রতিদিন এখানে অনেক মানুষের ভিড় দেখি। আজ এখানে এসে ভিড়ের কারণ বুঝলাম। তবে খরচ একটু চড়া।’

দর্শনার্থীদের জন্য এই গ্যালারি উন্মুক্ত থাকে বেলা ২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত। রবি ও সোমবার সাপ্তাহিক বন্ধ। সাধারণভাবে টিকিটের মূল্য ৪০০ টাকা। তবে ১০ বছরের কম বয়সীদের জন্য ২৫০ টাকা।