বিমানে যাত্রীদের এ কেমন আচরণ

গত মে মাসে বিমানের লন্ডনগামী একটি ফ্লাইট থেকে এসব আবর্জনা বের করা হয়। এই আবর্জনা যাত্রীদের আসনের পাশে ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায় পড়ে ছিল। বড় পলিথিনের ১৫টি প্যাকেটে করে ময়লা-আবর্জনা সরাতে হয় বিমানের ক্রুদের। ছবি: সংগৃহীত
গত মে মাসে বিমানের লন্ডনগামী একটি ফ্লাইট থেকে এসব আবর্জনা বের করা হয়। এই আবর্জনা যাত্রীদের আসনের পাশে ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায় পড়ে ছিল। বড় পলিথিনের ১৫টি প্যাকেটে করে ময়লা-আবর্জনা সরাতে হয় বিমানের ক্রুদের। ছবি: সংগৃহীত

আধুনিক উড়োজাহাজ দিয়ে বর্তমানে যাত্রীসেবা দিচ্ছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। আন্তর্জাতিক ১৬টি রুটে এবং অভ্যন্তরীণ ৮টি রুটে চলাচল করছে বিমানের উড়োজাহাজ। নতুন নতুন রুটেও চলাচলের পরিকল্পনা রয়েছে রাষ্ট্রের পতাকাবাহী বিমান। কিন্তু বিমানের উড়োজাহাজে ওঠার পর সব যেন এলোমেলো হয়ে যায়। চারদিকে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকে ময়লা-আবর্জনা।

বিমানের ফ্লাইট পরিচালনাকারীরা বলছেন, আকাশপথে চলতে গিয়ে তাঁদের উড়োজাহাজগুলো অনেক সময় যেন ময়লা ফেলার ‘ভাগাড়ে’ পরিণত হয়। ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ময়লা ফেলার কারণে তা পরিষ্কার করতে কখনো কখনো ফ্লাইটের বিলম্বও হয়। এতে বিশ্বের কাছে যেমন বিমানের, তেমনি বাংলাদেশেরও ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।

বিমানের বহরে বর্তমানে রয়েছে ১৪টি উড়োজাহাজ। সম্প্রতি একটি ড্যাশ-৮ মডেলের উড়োজাহাজ মিয়ানমারে বিধ্বস্ত হওয়ায় ১৩টি উড়োজাহাজ দিয়ে যাত্রীসেবা দিচ্ছে বিমান। সচল উড়োজাহাজগুলোর মধ্যে ১২টি মার্কিন উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িংয়ের। এর মধ্যে চারটি হলো সুপরিসর বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর মডেলের। দুটি হলো নতুন প্রজন্মের উড়োজাহাজ হিসেবে খ্যাত বোয়িং ৮৭৮-৮ ড্রিমলাইনার। আরও আছে দুটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের উড়োজাহাজ। আরও দুটি ড্রিমলাইনার খুব শিগগির যোগ হতে যাচ্ছে বিমানবহরে।

এ ছাড়া ভাড়ায় আনা হয়েছে তিনটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ ও তিনটি ড্যাশ-৮ মডেলের উড়োজাহাজ। ২০২০ সালের মধ্যে আরও তিনটি ড্যাশ-৮ উড়োজাহাজ কিনে আনছে বিমান। সব মিলিয়ে আগামী এক বছরের মধ্যে বিমানের উড়োজাহাজের সংখ্যা দাঁড়াবে ১৮। এই ১৮টি উড়োজাহাজের মধ্যে ১০টি নিজস্ব অর্থায়নে কিনেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। ২০০৭ সালে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত হওয়ার পর বোয়িংয়ের সঙ্গে এই ১০টি উড়োজাহাজ কেনার চুক্তি করে বিমান। এর মধ্যে চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর, চারটি ড্রিমলাইনার এবং দুটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০। বাংলাদেশের মুদ্রায় এসব উড়োজাহাজ ১৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা হয়। বোয়িংয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুয়ায়ী, ৪১৯ আসনের একটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজের মূল্য প্রায় ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা। একটি ড্রিমলাইনারের মূল্য ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা এবং একটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ মডেলের উড়োজাহাজের মূল্য ৯০০ কোটি টাকা।

তবে বিমানের এসব আধুনিকায়নের প্রয়াস ম্লান হয়ে যাচ্ছে অপরিচ্ছন্নতার কারণে। বিদেশে ফ্লাইট পরিচালনার সময় মূল্যবান এসব উড়োজাহাজে জমে যায় ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। নির্দিষ্ট গন্তব্যে অবতরণের পর বিমানের উড়োজাহাজগুলোয় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা আবর্জনা বস্তার পর বস্তা ভরে বের করে আনতে হয়। বিমানের বেশ কয়েকজন কেবিন ক্রুর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তাঁরা জানান, নির্দিষ্ট স্থানে আবর্জনা ফেলার নির্দেশনা দেওয়া হলেও যাত্রীরা সেটি মানেন না। দূরবর্তী গন্তব্য কিংবা স্বল্প দূরত্বের গন্তব্যে একই ধরনের বিড়ম্বনায় পড়তে হয় তাঁদের।

এই কেবিন ক্রুরা জানান, ময়লা–আবর্জনা নিয়ে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হয় ঢাকা-লন্ডন-ঢাকা রুটের ফ্লাইটে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমানের এক কেবিন ক্রু প্রথম আলোকে বলেন, এশিয়া মহাদেশ ছাড়া ঢাকা-লন্ডন-ঢাকা হচ্ছে বিমানের একমাত্র ইউরোপীয় রুট। এই রুটে তাঁকে প্রতি মাসে গড়ে চারটি ফ্লাইটে যেতে হয়। লন্ডন রুটে তাঁদের সবচেয়ে বড় উড়োজাহাজ বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর দিয়ে ফ্লাইটে পরিচালনা করে বিমান। ৪১৯ আসনের এই বিমানে অধিকাংশ সময় বাংলাদেশি যাত্রীরা আসা-যাওয়া করেন। অনেক ভিআইপি যাত্রীও থাকেন। কিন্তু বিদেশি যাত্রীরা নিয়ম মানলেও দেশের যাত্রীরা নিয়মের তোয়াক্কা করেন না। প্রায় ১০ ঘণ্টার যাত্রাপথে প্রত্যেক যাত্রীকে পর্যাপ্ত খাবার পরিবেশন করা হয়। বিমানের ভেতর প্রতিটি আসনের সঙ্গে প্যাকেট থাকলেও অধিকাংশ যাত্রী সেখানে খালি প্যাকেট ফেলেন না। নাশতা অথবা ভারী খাবার খাওয়ার পর টিস্যুও আসনের নিচে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায়।

বিমানের আরেক ফ্লাইট স্টুয়ার্ট বলেন, ‘আমরা কিছুক্ষণ পরপর বক্স নিয়ে আসি। এ ছাড়া বারবার ঘোষণা দিয়ে যাত্রীদের সিট পকেটে অপ্রয়োজনীয় বস্তু ফেলার নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু যাত্রীরা সেই নির্দেশ মানেন না। উল্টো আসনের নিচে, চলাচলের মধ্যবর্তী স্থানে ময়লা ফেলে রাখেন। কিছু বলার চেষ্টা করলে তাঁরা রেগে যান। গালমন্দও করেন। অথচ বিদেশি বিমান সংস্থার ফ্লাইটে এই অবস্থা হয় না। যাত্রীরা নিয়ম মানেন, সচেতন থাকেন। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ফ্লাইটে ওঠার পর আমাদের দেশের যাত্রীরাই যেন কেমন হয়ে যান! অথচ রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থার উড়োজাহাজ ব্যবহারে আমাদের নিজেদেরই যত্নবান হওয়ার কথা।’

কেবিন ক্রুরা বলেন, লন্ডনে অবতরণের দুই ঘণ্টা আগে থেকে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা ব্যবহৃত টিস্যু, চিপসের প্যাকেট, বাচ্চাদের ডায়াপারসহ ময়লা সংগ্রহ করতে থাকি। এই কাজ করার কারণ হলো, আগেভাগে ময়লা ব্যাগে ভরা হলে যেন ফিরতি ফ্লাইটে বিলম্ব না হয়।

কক্সবাজার থেকে ঢাকায় আসতে এক ঘণ্টারও কম সময় লাগে বিমানের ড্যাশ-৮–এর। স্বল্প দূরত্বের এই ফ্লাইটেও আবর্জনা জমে যায়। বিমানের এই শৌচাগারটির অবস্থা এতই নোংরা যে ছবিতে পুরোপুরি প্রকাশ করা গেল না। ছবি: সংগৃহীত
কক্সবাজার থেকে ঢাকায় আসতে এক ঘণ্টারও কম সময় লাগে বিমানের ড্যাশ-৮–এর। স্বল্প দূরত্বের এই ফ্লাইটেও আবর্জনা জমে যায়। বিমানের এই শৌচাগারটির অবস্থা এতই নোংরা যে ছবিতে পুরোপুরি প্রকাশ করা গেল না। ছবি: সংগৃহীত

আবর্জনা জমার কারণ সম্পর্কে বিমানের পাইলট ও কেবিন ক্রুরা বলেন, গত মে মাসে ঢাকা থেকে লন্ডনগামী বিমানের একটি ফ্লাইটে একাধিক ভিআইপি যাত্রী ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে সাধারণ যাত্রী ছিলেন। কিন্তু সাধারণ যাত্রীর পাশাপাশি ভিআইপি যাত্রীরাও একইভাবে ময়লা ফেলে রেখে যান। হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর ওই ফ্লাইট থেকে ছড়ানো অবস্থায় ১৫টি বড় পলিথিনে করে আবর্জনা বের করতে হয়। তা ছাড়া বিমানের লন্ডন ফ্লাইটে ২ বছর থেকে ১২ বছর বয়সী অসংখ্য যাত্রী থাকে। প্রতি ফ্লাইটে প্রায় ১০০ জনের বেশি শিশু থাকে। এমিরেটস, সৌদিয়া, কাতার এয়ারওয়েজের শিশুদের জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক আসন বরাদ্দ থাকে। বিমানে এই নিয়ম মানা হয় না। তা ছাড়া প্রতি যাত্রীর জন্য ৪০ কেজি মালামাল বহনের নিয়ম রয়েছে। কিন্তু দেখা যায়, বিমানে আরও বেশি পরিমাণ মালামাল নিয়ে ওঠেন। শিশুর সংখ্যা বেশি থাকায় বিমানের ভেতর আবর্জনাও বেশি জমে।

জানা গেছে, গত বছর ময়লা-আবর্জনার পরিষ্কার করতে বিমানের লন্ডনের একটি ফ্লাইটে অতিরিক্ত এক ঘণ্টা সময় বেশি লেগেছিল। হিথরো বিমানবন্দরের ক্লিনাররা এ নিয়ে বিমানের কেবিন ক্রুদের ঠাট্টাও করেছিলেন।

তবে মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ব্যাংকক ফ্লাইটে উড়োজাহাজের ভেতরের চিত্র কিছুটা অন্য রকম। এসব রুটের ফ্লাইটে যাত্রী আসনের নিচে ময়লা কম থাকে। কিন্তু টয়লেটগুলো হয়ে যায় ভীষণ অপরিচ্ছন্ন। টয়লেট ব্যবহারের পর কমোড ফ্লাশ করা হয় না। ব্যবহৃত টিস্যুও যাত্রীরা টয়লেটের ভেতর ছড়িয়ে–ছিটিয়ে ফেলে রাখেন। অথচ টিস্যু ফেলার বক্সগুলো রয়ে যায় ফাঁকা।

কেবল আন্তর্জাতিক রুটে নয়, বিমানের অভ্যন্তরীণ রুটের ফ্লাইটের ক্ষেত্রেও উড়োজাহাজের ভেতর ময়লা-আবর্জনা পড়ে থাকে। কক্সবাজার থেকে ঢাকায় আসতে এক ঘণ্টারও কম সময় লাগে বিমানের ড্যাশ-৮–এর। স্বল্প দূরত্বের এই ফ্লাইটেও আবর্জনা জমে যায়।

ময়লা-আবর্জনা নিয়ে বিড়ম্বনার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিমানের উপমহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) তাহেরা খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফ্লাইট ছাড়ার আগে বিমানের ক্রুরা যাত্রীদের নির্দেশনা দেন। সময় নিয়ে কী করণীয়, তা বলা হয়। তবে এরপরও উড়োজাহাজের ভেতর যত্রতত্র পড়ে থাকে আবর্জনা। যাত্রীদের সচেতনতার অভাবে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। তাঁরা যদি সচেতন হন, তাহলে এমনটি হতো না।’