আয়কর নথি, ব্যাংক হিসাব তলব করতে পারবে দুদক

তদন্ত বা অনুসন্ধানের জন্য আয়কর বিভাগ এবং ব্যাংকগুলোর কাছে ব্যক্তির যাবতীয় তথ্য সরাসরি তলব করতে পারবে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ ছাড়া গুরুত্ব বিবেচনায় দুদক অভিযোগ অনুসন্ধান না করেই সরাসরি মামলা দায়ের করতে পারবে।
দুদক আইনের সংশোধিত বিধিমালার গেজেটে এ কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, দুদক আইনের তফসিলভুক্ত কোনো অপরাধ বিষয়ে কেউ থানায় অভিযোগ দায়ের করলেও তা চলে যাবে থানার পরিবর্তে সংস্থাটির ২২টি সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে। নতুন বিধি অনুযায়ী অনুসন্ধান বা তদন্ত চলাকালে দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আদালতের মাধ্যমে অভিযুক্ত ব্যক্তির নামে বা বেনামে থাকা সম্পত্তি ক্রোক বা অবরুদ্ধ করতে পারবেন।

২০০৪ সালে দুদক আইন পাস হওয়ার পর ২০০৭ সালে দুদক বিধিমালা জারি হয়। প্রায় এক যুগ পর বিধিমালাটি সংশোধন করে দুদকের বিদ্যমান ক্ষমতা আরও বাড়ানো হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইনগতভাবে স্বাধীন ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের জন্য দুদকের ক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। তবে তাঁরা এই ক্ষমতার অপপ্রয়োগের আশঙ্কা প্রকাশ করে সাম্প্রতিক সময়ে দুদকের কিছুসংখ্যক কর্মকর্তার দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন।
দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বিধির এই সংশোধন দুদক আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদককে গড়ে তুলতে এমন বিধি দরকার। তবে ব্যক্তির অবস্থান বা পরিচয়ের ওপর যদি এই আইন বা বিধির প্রয়োগ হয় এবং সেটি যদি বৈষম্যমূলক হয়, তাহলে প্রতিষ্ঠানটি বরং বিতর্কিত এবং অকার্যকর হয়ে যাবে। এ প্রসঙ্গে তিনি দুদকের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগের কথা উল্লেখ করে বলেন, দুদকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা এবং জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করার ওপর এই বিধির সাফল্য নির্ভর করবে।

মামলা, আয়কর ও ব্যাংক হিসাব
বিধিমালা সংশোধনের পর কেউ যদি থানায় দুর্নীতির অভিযোগ করেন, সে ক্ষেত্রে পুলিশ তা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হিসেবে রেকর্ড করবে। পরে তা অনুসন্ধানের জন্য দুই কার্যদিবসের মধ্যে দুদকে পাঠাবে।
অভিযোগের অনুসন্ধান বা মামলার তদন্তের জন্য তদন্ত বা অনুসন্ধান কর্মকর্তা ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য নিতে পারবেন। এমনকি আয়কর অফিস থেকে হিসাব বিবরণীসহ আনুষঙ্গিক সব তথ্য জব্দ বা অনুলিপি তলব করতে পারবেন।
অবশ্য দুদকের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, বিধি সংশোধন করে যেসব ক্ষমতা দুদককে দেওয়া হয়েছে, তা আগে থেকেই ছিল। কিন্তু অনেকেই এটা জানতেন না। বেশ কিছু অস্পষ্টতাও ছিল। সংশোধিত বিধির মাধ্যমে সব বিষয় স্পষ্ট করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, আইনে দুদকের অনেক ক্ষমতা, এটা আগেও ছিল। এখন বিধি সংশোধন করে তা স্পষ্ট করা হচ্ছে। তাঁর মতে, দুদক আইন অন্য সব আইনের ওপরে এবং এটা ২০১৩ সালের সংশোধিত আইনে বলা আছে। তিনি মনে করেন, আইন বা বিধি কেবল থাকলেই হবে না। এর বাস্তবায়নে সৎ, দক্ষ ও যোগ্য কর্মকর্তা দরকার। দুদকের সক্ষমতা আরও বাড়ানোর সুযোগ আছে।

সম্পত্তি ক্রোক
কোনো ব্যক্তির জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ সম্পত্তি থাকলে তা ক্রোক বা অবরুদ্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আদালতে আবেদন করতে পারবেন। এই সম্পত্তি অভিযুক্ত ব্যক্তির নামে বা বেনামে বা দখলে থাকলেও তা ক্রোকের আবেদন করা যাবে। এমনকি অভিযুক্ত ব্যক্তির সম্পত্তি সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত বা শনাক্ত করা না গেলে অথবা অন্য কোনো কারণে সম্পত্তি ক্রোক না করা গেলে ওই ব্যক্তির সমমূল্যের অন্য সম্পত্তি ক্রোক করতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আদালতে আবেদন করতে পারবেন।
স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করা হলে এর হস্তান্তর বা লেনদেন নিষিদ্ধ করার বিষয়ে আদালতের আদেশ বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করা হবে। ভূমি কার্যালয় ও সাবরেজিস্ট্রারকে বিষয়টি অবহিত করা হবে। এ ছাড়া কোনো ব্যাংক হিসাব বা লকার অবরুদ্ধ করা হলে তা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ব্যবস্থাপককে অবহিত করা হবে। শেয়ার বা ডিবেঞ্চার ক্রোক করা হলে তা স্টক এক্সচেঞ্জ, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে জানানো হবে। এ ছাড়া নৌযান, স্থলযান এবং আকাশযান ক্রোক করা যাবে এবং এসব যানবাহন যাতে না চলতে পারে, সে জন্য প্রত্যেক যানের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে (বিমান, নৌপরিবহন বা সড়ক পরিবহন) আদালতের নির্দেশ জানিয়ে দেওয়া হবে।

>

কেউ থানায় দুর্নীতির অভিযোগ করলে পুলিশ জিডি হিসেবে রেকর্ড করবে
অনুসন্ধানের জন্য দুই কার্যদিবসের মধ্যে দুদকে পাঠাবে

আরও যেসব বিষয়
দুদকের কর্মকর্তারা জানান, সংস্থার সমন্বিত ২২টি কার্যালয়ে মামলা করা যাবে। তবে সেগুনবাগিচায় কমিশনের প্রধান কার্যালয় এবং আটটি বিভাগীয় কার্যালয়ে কোনো মামলা করা যাবে না। আগের বিধিতে অনুসন্ধানের সময় ছিল নির্দেশ পাওয়ার পর থেকে ১৫ দিন, নতুন বিধিতে তা ৪৫ দিন করা হয়েছে। তবে যুক্তিসংগত কারণ থাকলে তা আরও ৩০ দিন বাড়ানো যাবে।

গতকাল রোববার রাত পর্যন্ত বিধি সংশোধনের গেজেট ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়নি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য বলেন, বিধিমালাটির গেজেট গতকাল প্রকাশিত হলেও এটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়নি। তাঁর মতে, এই বিধির ফলে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদকের ক্ষমতা বিকশিত হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ব্যক্তির সাংবিধানিক অধিকার সুরক্ষা করেই সব আইন বা বিধি প্রণয়ন বা প্রয়োগ করা দরকার। আয়কর ফাইল তলব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ব্যক্তির আয়কর-সংক্রান্ত বিষয় দেখভাল করার দায়িত্ব আয়কর বিভাগের। সেখানে দুদক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সংশ্লিষ্ট আইন বা বিধির মধ্যে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
শাহদীন মালিক আরও বলেন, ‘আমরা একটি শক্তিশালী দুদক চাই। কিন্তু মানুষের আস্থা অর্জন এবং সক্ষমতা ছাড়া দুদকের ক্ষমতা বাড়ানো হলে তা আইন বা বিধির অপব্যবহারের সম্ভাবনা বাড়াবে। বড় দুর্নীতিবাজদের তেমন কিছুই হচ্ছে না এবং ছোটখাটোদের ধরার দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তিনি বলেন, বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যানের তো কিছুই হয়নি। অথচ ওই ব্যাংকের অনেকে জেলে। এমনটি হলে ক্ষমতা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।