মানবসেবার স্বপ্ন পূরণ হলো না ফাহমিদার

ফাহমিদা ইয়াসমিন
ফাহমিদা ইয়াসমিন

চেয়েছিলেন চিকিৎসক হয়ে এলাকার অসহায় মানুষের সেবা করবেন। কিন্তু মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্নে ভাটা পড়লেও ছাড়েননি মানুষের সেবার স্বপ্ন। পরিবারের উৎসাহ ও সহযোগিতায় ভর্তি হন নার্সিং কলেজে। কিন্তু পড়া শেষ করে স্বপ্ন পূরণের আগেই তাঁকে জীবন থেকে বিদায় নিতে হলো।

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া বরমচালে গত রোববার রাতে উপবন এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত হন সিলেট নার্সিং কলেজের ছাত্রী ফাহমিদা ইয়াসমিন। সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার জালালপুরের আবদুল্লাহপুর গ্রামের আবদুল বারীর মেয়ে ফাহমিদার মৃত্যুতে পরিবারে এখন চলছে শোকের মাতম।

তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তৃতীয় ফাহমিদা ইয়াসমিন। বাবা আবদুল বারী সৌদিপ্রবাসী ছিলেন। ২০০৪ সালের দিকে ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে দেশে ফেরেন। এরপর থেকে সংসারের দায়িত্ব, চার ভাইবোনের পড়ালেখা এবং বাবার চিকিৎসার দায়িত্ব কাঁধে নেন আবদুল বারীর বড় ছেলে আবদুল হামিদ। ছোট বোন ফাহমিদা ইয়াসমিনের আকস্মিক মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না আবদুল হামিদ। শুধু আবদুল হামিদ নন, মেয়েকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মা রহিমা বেগম। কিছু সময় পরপর বিলাপ করতে করতে মূর্ছা যাচ্ছেন। প্রতিবেশীরাও ফাহমিদার পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দিতে আসেন। কান্নায় বাড়ির পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছে। গতকাল মঙ্গলবার বেলা একটার দিকে জালালপুরের আবদুল্লাহপুর গ্রামে ফাহমিদাদের বাড়ি গিয়ে দেখা গেছে এমন চিত্র।

ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থী ফাহমিদার কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা রহিমা বেগম ও মামা লিলু মিয়া। গতকাল দক্ষিণ সুরমার জালালপুর গ্রামে।  প্রথম আলো
ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থী ফাহমিদার কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা রহিমা বেগম ও মামা লিলু মিয়া। গতকাল দক্ষিণ সুরমার জালালপুর গ্রামে। প্রথম আলো

আবদুল হামিদ জানান, তাঁর বোনের ইচ্ছে ছিল চিকিৎসক হয়ে এলাকার অসহায় মানুষের সেবা করবেন। কিন্তু মেডিকেলে টিকতে পারেননি। বেসরকারি মেডিকেলে পড়ানোর সামর্থ্যও নেই। তাই বিএসসি নার্সিং ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সিলেট নার্সিং কলেজে ভর্তি হন ফাহমিদা। প্রায়ই বলতেন, চার বছরের নার্সিং পাস করার পর সরকারি হাসপাতালে চাকরি নেবেন। এতে সংসারের বোঝা অনেকটা কমবে। এবার তৃতীয় বর্ষে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রতিটি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করেছিলেন। এলাকার কেউ সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে তাদের সহযোগিতা এবং সেবা করতেন তিনি। এলাকায় অনেকেই সুস্থ হয়ে ফিরে ফাহমিদার প্রশংসা করত। গত সোমবারও তাঁর মামা লিলু মিয়ার এলাকার এক নারী মামার কাছে ফাহমিদার মুঠোফোন নম্বর চেয়েছিলেন। কথাগুলো বলতে গিয়ে কান্নায় কণ্ঠ জড়িয়ে আসছিল আবদুল হামিদের।

আবদুল হামিদ জানান, গত শুক্রবার ফাহমিদা শেষবারের মতো বাড়িতে এসেছিলেন। তখন মা-বাবাকে জানিয়েছিলেন, দুদিন পর ঢাকায় কোনো কর্মশালায় যোগ দিতে সহপাঠীর সঙ্গে যাবেন। পরে রোববার রাতে ট্রেনে করে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। রাত তিনটার দিকে মুঠোফোনে তাঁর এক সহপাঠী জানান, ফাহমিদা আহত হয়ে কুলাউড়ার একটি হাসপাতালে রয়েছেন। পরে সেখানে গিয়ে বোনের মৃত্যুর খবর জানতে পারেন হামিদ।

আবদুল হামিদ আরও বলেন, ‘দেশের অন্য অঞ্চলের চেয়ে সিলেটের রেলপথের অবস্থা খুবই নাজুক। রেলওয়েতে কর্মরত ব্যক্তিরা যদি নিজের কাজ ঠিকমতো করতেন, তাহলে এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটত না। আমাদেরও অকালে বোন হারাতে হতো না।’

এদিকে ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহত সিলেট নার্সিং কলেজের ছাত্রী সানজিদা আক্তারের মরদেহ গতকাল দুপুরে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইউনুছুর রহমান পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছেন। নিহত সানজিদার বাড়ি খুলনা জেলার বাগেরহাটে।

ট্রেন দুর্ঘটনায় দুই ছাত্রী নিহতের ঘটনায় গতকাল থেকে সিলেট নার্সিং কলেজে তিন দিনব্যাপী শোক কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও কলেজে কর্মরত নার্স, শিক্ষক এবং চিকিৎসকেরা কালো ব্যাজ ধারণ করে শোক পালন করছেন।