ট্রেন দুর্ঘটনায় যাত্রীর মৃত্যুতে ক্ষতিপূরণ মাত্র ১০ হাজার টাকা

ট্রেন দুর্ঘটনায় কোনো যাত্রীর প্রাণহানি হলে কিংবা কেউ আহত হলে, ওই যাত্রীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে আইনত বাধ্য রেল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু রেলের এই ক্ষতিপূরণ দিয়ে মৃতের সৎকার কিংবা আহতদের চিকিৎসা করাই কঠিন। কারণ, ৭৬ বছর আগে করা আইনে সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ মাত্র ১০ হাজার টাকা। গত বছর রেল কর্তৃপক্ষ এই ক্ষতিপূরণ বাড়ানোর উদ্যোগ নিলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি।

১৮৯০ সালের রেলওয়ে আইনের ৮২-এ ধারায় যাত্রীবাহী ট্রেনের দুর্ঘটনায় রেল কর্তৃপক্ষের দায়দায়িত্ব উল্লেখ করা হয়েছে। এটি সর্বশেষ ১৯৪৩ সালে সংশোধন করা হয়। এতে বলা হয়, রেল কর্তৃপক্ষের কারণে ট্রেন দুর্ঘটনায় কোনো যাত্রীর প্রাণহানি কিংবা আহত হলে অথবা যাত্রীর কর্মক্ষমতা নষ্ট হলে এর জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। এমনকি যাত্রীর সঙ্গে থাকা ব্যক্তি এবং মালামালের জন্যও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আইনে সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ ১০ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। চাইলে আহতদের আরও কম ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব। তবে রেল কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ক্ষতিপূরণের টাকা ১০ হাজারই দেওয়া হয়।

রেলওয়ে আইনে শুধু টিকিটধারী যাত্রীদেরই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কিন্তু দুর্ঘটনায় ট্রেনের যাত্রীর বাইরে (ট্রেনে কাটা পড়ে বা ট্রেনের সঙ্গে গাড়ির সংঘর্ষে) কেউ নিহত বা আহত হলে কোনো ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নেই।

রেলওয়ের তথ্য বলছে, ১৯৯৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৯ বছরে ৪০০ মানুষ ট্রেন দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন। রেলের একজন কর্মকর্তা বলেন, রেল দুর্ঘটনার হার কম। হতাহতের পরিমাণও বেশি নয়। এবারের বাজেটে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের জন্য ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ করা হয়েছে। দুর্ঘটনায় হতাহতদের জন্য ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বাড়ালে সমস্যা হবে না। এতে হতাহতের পরিবার কিছুটা হলেও উপকৃত হতো।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ব্রিটিশ আমলে কর্মকর্তাদের বেতন হিসাব করা হতো শ টাকায়। তখনকার বিবেচনায় ১০ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ ঠিকই আছে। এখন ১০ লাখ টাকা হলেও কম হবে। আইনটা যুগোপযোগী করা উচিত। গত এক দশকে যাত্রী ভাড়া দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। যাত্রীরা সেবা পাচ্ছে না। মারা যাওয়ার পর ক্ষতিপূরণ না পাওয়া তো তামাশার শামিল।

গত রোববার রাতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনের পাঁচটি বগি লাইনচ্যুত হলে চারজন প্রাণ হারান। আহত হন শতাধিক যাত্রী। এর আগে ২০১৩ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের অবরোধ কর্মসূচির সময় রেললাইনের ফিশপ্লেট খুলে রাখার কারণে ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে চারজন নিহত হন। ওই সময় আরও বেশ কিছু নাশকতার ঘটনায় ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে কয়েক শ মানুষ আহত হন। ২০১০ সালে নরসিংদী রেলস্টেশনে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ট্রেনের একজন চালকসহ ১২ জন প্রাণ হারান।

>

ব্রিটিশ আমলের ক্ষতিপূরণ আইনে চলছে রেল
আইনে সর্বোচ্চ ক্ষতিপূরণ ১০ হাজার টাকা
ভারতে ট্রেন দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে ক্ষতিপূরণ ৪ লাখ রুপি

রেলের কর্মকর্তারা জানান, দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ পাওয়ার বিষয়টি অনেকেই জানেন না। আবার যাঁরা জানেন, ক্ষতিপূরণের পরিমাণ কম বলে দাবি করেন না।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, ট্রেন লাইনচ্যুতির দুটি বড় ঘটনা ঘটে ১৯৮৯ সালে। ওই বছর গাজীপুরের পুবাইলের কাছে এবং চট্টগ্রামে কুমিরায় পৃথক ট্রেন দুর্ঘটনায় মোট ৮১ জন প্রাণ হারান। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ বিশেষ ক্ষমতাবলে নিহতদের পরিবারকে এক লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেন।

রেলওয়ে সূত্র জানায়, গত বছরের ২৮ মে রেলের তৎকালীন মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন ক্ষতিপূরণ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দেন। এতে বলা হয়, বর্তমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ক্ষতিপূরণের হার পুনর্নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এতে উল্লেখ করা হয়, ভারতে ট্রেন দুর্ঘটনায় কারও প্রাণহানি হলে বা স্থায়ীভাবে অক্ষম হয়ে পড়লে এককালীন চার লাখ রুপি (ভারতীয় মুদ্রা) দেওয়া হয়। আর দুর্ঘটনায় রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারী মারা গেলে ২০ লাখ রুপি ক্ষতিপূরণের বিধান রয়েছে।

বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবে ক্ষতিপূরণ বাবদ (মৃত্যু বা স্থায়ীভাবে পঙ্গু হয়ে গেলে) সাড়ে তিন লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হয়। আহত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে অবস্থাভেদে সর্বনিম্ন ২০ হাজার থেকে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণের প্রস্তাব করা হয়। তবে এই প্রস্তাব নিয়ে আর কোনো অগ্রগতি নেই।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোফাজ্জেল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষতিপূরণের যে অর্থ, তা আসলেই নগণ্য। এটা পরিবর্তন হওয়া দরকার। এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তিনি বলেন, কুলাউড়ার ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে রেলমন্ত্রীর পক্ষ থেকে বাড়তি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।