'বন বিভাগ গাছ লাগানো বোঝে, বন বুঝে কি না, সন্দেহ'

জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘বন আইন, বিধিমালা ও বনবাসী মানুষের অধিকার’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তব্য দেন চাকমা সার্কেলপ্রধান রাজা দেবাশীষ রায়। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ
জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘বন আইন, বিধিমালা ও বনবাসী মানুষের অধিকার’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তব্য দেন চাকমা সার্কেলপ্রধান রাজা দেবাশীষ রায়। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

‘আমাদের বন বিভাগ গাছ লাগানো ভালো বোঝে কিন্তু বন বোঝে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।’ 

বন সুরক্ষায় বন বিভাগের সমালোচনায় কথাগুলো বললেন চাকমা সার্কেলপ্রধান রাজা দেবাশীষ রায়। আজ বুধবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘বন আইন, বিধিমালা ও বনবাসী মানুষের অধিকার’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় তিনি এ কথা বলেন। ভূমি অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) এর আয়োজন করে।

আজকের অনুষ্ঠানে বিচারপতি, আইনজীবী, অধিকারকর্মী, বননির্ভর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তাঁদের সামনেই বাংলাদেশের বন, বন আইন, বন আইন ও বিধিমালার ঐতিহাসিক পরম্পরা নিয়ে মূল প্রবন্ধ তুলে ধরেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী দেবাশীষ রায়। তিনি বলেন, ‘যখন বন ছিল, তখন বন বিভাগ ছিল না। বন বিভাগ সৃষ্টি হওয়ার পরই বন ধ্বংস শুরু হয়েছে।’

১৯২৭ সালের ব্রিটিশ আমলে বন আইন করা হয়। প্রায় শতাব্দীপ্রাচীন আইনটির নানা দিক নিয়ে সমালোচনা করেন দেবাশীষ রায়। তিনি বলেন, ‘ব্রিটিশ সরকার বন আইন করেছিল বন থেকে রেলওয়ে ও জাহাজের জন্য কাঠ সংগ্রহ করার জন্য। তাদের বনের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা ছিল না। আজও সেই আইন কীভাবে আমাদের দেশে থাকতে পারে সেটি প্রশ্ন।’
রাজা দেবাশীষ তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ভারত এবং উপমহাদেশের অন্যান্য দেশেও পুরোনো বন আইন আছে। কিন্তু এসব দেশে এখন সেই আইন সংশোধন করে যুগোপযোগী করা হয়েছে। বননির্ভর মানুষের অধিকার দিয়ে ভারতে বন সংরক্ষণ আইন হয়েছে নতুন করে। নেপালেও সংশোধন করে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করে আইন হয়েছে। শুধু বাংলাদেশেই বননির্ভর মানুষের সুরক্ষা নেই।

চাকমা সার্কেলপ্রধান বলেন, সংরক্ষিত, রক্ষিত, ইকোপার্ক, বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য ইত্যাদি নানা নামে বনকে বিভাজিত ও অভিহিত করা হয়। কিন্তু বনের সুরক্ষা হয় না। পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি বিশাল অংশের বনকে বন বিভাগ ‘অশ্রেণিভুক্ত রাষ্ট্রীয় বন’ হিসেবে অভিহিত করে। তবে আইনে এ ধরনের কোনো বন নেই। ওই বনকে জেলা প্রশাসন বলে খাস জমি। আর পাহাড়ি মানুষ মনে করে তাদের প্রথাগত সম্পত্তি।
বনের নানা কার্যক্রমের সঙ্গে বনবাসী মানুষকে সম্পৃক্ত না করায় বন বিভাগের সমালোচনা করেন দেবাশীষ রায়। তিনি বলেন, ‘বননির্ভর আদিবাসী মানুষ বন বিভাগকে শেখাতে পারে বন কাকে বলে। বনের সুরক্ষায় এসব মানুষের সহযোগিতা লাগবে।

আজকের অনুষ্ঠানে বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী রিজওয়ানা হাসান বলেন, কক্সবাজারে ৮০০ একর বন কেটে বিসিএস কর্মকর্তাদের জন্য একাডেমি করবে সরকার। ওখানে যেসব কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ পাবেন, সেসব কর্মকর্তার বনের প্রতি কোনো মায়া জন্মাবে না।

রিজওয়ানা হাসান বলেন, যে ঔপনিবেশিক বন আইন এখনো টিকে আছে, সেখানে বন বিভাগের দায়িত্ব ও কর্তব্য বলে কোনো কথা নেই। এক ধরনের অস্বচ্ছতা ও অদক্ষতা বন বিভাগের কাজের মধ্যে রয়ে গেছে। আর সরকার সেটা জানে। তাই যখনই সরকারের কোনো জমির দরকার হয়, তখন তার চোখ পড়ে বন বিভাগের জমির ওপর। আর বন বিভাগ তা দিয়ে দেয়।

রিজওয়ানা হাসানের মতো বন আইনের সমালোচনা করেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর এই নেতা বলেন, বনকে বননির্ভর জাতিগোষ্ঠীর মানুষ দেখে জীবনের অংশ হিসেবে। কিন্তু বন বিভাগ এসব মানুষকে বিবেচনা করে প্রতিপক্ষ হিসেবে। যত দিন এসব মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক না হবে, বন বিভাগের তত দিন বন বিনাশ রোধ হবে না।
এখনকার বন আইন পরিবর্তন করে বন সংরক্ষণের নতুন আইন প্রবর্তনের দাবি করেন সঞ্জীব দ্রং।

আজকের অনুষ্ঠানের সভাপতি সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম বলেন, বন বিভাগের কর্মকর্তাদের বোঝা উচিত তাঁদের দায়িত্ব বনের উপকার, বননির্ভর মানুষকে অপমান নয়।

অনুষ্ঠানে এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, ‘বননির্ভর জনগোষ্ঠীর অধিকারকে স্বীকৃতি না দিলে বনের সুরক্ষা হবে না। এটা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে। এই সহজ সত্যকে আমরা আজও বুঝতে পারছি না।’

সাংবাদিক আবু সাঈদ খান বলেন, এখন দেশে বনখেকো তৈরি হয়েছে। তবে এসব বনখেকোকে শাস্তি না দিয়ে সরকার কখনো কখনো বনখেকোর ভূমিকা নিয়ে নেয়।


আলোচনায় স্বাগত বক্তব্য দেন এএলআরডির উপনির্বাহী পরিচালক রওশন জাহান মনি।