প্রশ্নপত্র ফাঁস: ৭৭ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁসের মামলায় ৭৭ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। পাবলিক পরীক্ষা আইনের মামলায় দেওয়া অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে ঢাকার মহানগর হাকিম মো. সারাফুজ্জামান আনসারী আজ বুধবার এই আদেশ দেন।

যাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে, তাঁদের গ্রেপ্তার করা গেল কি না, তা আগামী ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে আদালতকে জানানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আদালত সূত্র বলছে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে ২৩ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৭ জন শিক্ষার্থীসহ ১২৫ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন এবং পাবলিক পরীক্ষা আইনে পৃথক দুটি অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।

আজ বুধবার পাবলিক পরীক্ষা আইনের মামলার অভিযোগপত্র আমলে নেন আদালত। আর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের মামলার অভিযোগপত্র আদালত দেখেছেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হলেন সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার সুমন কুমার দাস। পুলিশ এবং আদালত সূত্র বলছে, মামলার ১২৫ জন আসামির মধ্যে পলাতক ৭৭ জন। মামলার পর গ্রেপ্তার ৪৭ জন আসামি বর্তমানে জামিনে আছেন। তাঁদের মধ্যে ৪৬ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দেন।

এর আগে গত ৩০ মে মালিবাগের সিআইডি কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার প্রধান মোহা. শফিকুল ইসলাম জানান, প্রশ্নপত্র ফাঁসের এই মামলায় আরও অনেকের তথ্য যাচাইয়ের কাজ চলছে। সঠিক নাম-ঠিকানা পাওয়া গেলে তাঁদের বিরুদ্ধেও সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।

সিআইডির প্রধান জানান, অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি দল দীর্ঘ তদন্ত করে। তদন্তের মাধ্যমে তাঁরা দেশের সর্ববৃহৎ প্রশ্নপত্র ফাঁস ও ডিজিটাল জালিয়াত চক্রকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হন।

সিআইডির তালিকা ধরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জড়িত লোকজনের মধ্যে অন্তত ২১ জন ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতা-কর্মী। এই ২১ জনের মধ্যে ১৮ জন বিভিন্ন কমিটির পদধারী নেতা ছিলেন। আর তিনজন ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী।

তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, আসামিদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ২০১১ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় এই চক্রের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। পরীক্ষা শুরুর আগে প্রেস থেকে ছাপা প্রশ্ন নিয়ে প্রথমে তাঁরা মুঠোফোনে খুদে বার্তার মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের কাছে উত্তর পাঠাতেন। পরে তাঁরা ডিজিটাল যন্ত্রাংশের ব্যবহার বাড়ান। ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, অন্তত দুটো বিসিএস পরীক্ষাসহ বিভিন্ন সরকারি চাকরির প্রশ্নপত্র ফাঁসেও এই চক্র সক্রিয় ছিল। চক্রের মূল নেতারা অঢেল অবৈধ অর্থসম্পদের মালিক হন। এসব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে ইতিমধ্যে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মানি লন্ডারিং মামলাও করেছে সিআইডি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২০১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তি হওয়া এবং জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে এই ৮৭ জনের মধ্যে ১৫ জনকে বহিষ্কার করেছিল।

ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক ২১ নেতা-কর্মী
অভিযুক্তদের মধ্যে ছাত্রলীগের অন্তত ২১ জন সাবেক ও বর্তমান নেতা-কর্মী আছেন। তাঁরা হলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক উপসম্পাদক মহিউদ্দিন রানা, সহসম্পাদক বেলাল হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একুশে হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি মশিউর রহমান, আপ্যায়ন সম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন, কর্মসূচি ও পরিকল্পনা সম্পাদক আবু জোনায়েদ, পাঠাগার সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণা সম্পাদক মাসুদ রানা, এফ রহমান হলের পরিকল্পনা ও কর্মসূচি সম্পাদক লাভলু রহমান, জহুরুল হলের উপ-আন্তর্জাতিক সম্পাদক মো. বায়েজিদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের শিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক এম ফাইজার নাঈম, বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের উপগণশিক্ষা সম্পাদক আফসানা নওরিন, রোকেয়া হলের বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক ফাতেমা তুজ জোহরা, সূর্য সেন হলের উপপ্রচার সম্পাদক সাবিরুল ইসলাম, জগন্নাথ হলের বর্ধিত কমিটির সহসম্পাদক শাশ্বত কুমার ঘোষ, ঢাকা কলেজের সাবেক সহসভাপতি জাহাঙ্গীর আলম ও সাগর সাহা, সোহরাওয়ার্দী কলেজের সাবেক সহসভাপতি প্রণয় পাণ্ডে ও নালিতাবাড়ী উপজেলার সভাপতি রাজীবুল ইসলাম। হাসিবুর রহমান, খালিদ হাসান ও রবিউল ইসলাম ছাত্রলীগের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সক্রিয় কর্মী। এ ছাড়া আছেন মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ ময়মনসিংহ মহানগর শাখার সভাপতি ইশরাক হোসেন।

তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এ প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার শুরু ২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর মধ্যরাতে। ওই দিন গণমাধ্যমকর্মীদের কিছু তথ্যের সূত্র ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল থেকে ছাত্রলীগের নেতা মহিউদ্দিন রানা এবং অমর একুশে হল থেকে আবদুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। তাঁদের তথ্যের ভিত্তিতে পরদিন পরীক্ষার হল থেকে ইশরাক হোসেন নামের এক পরীক্ষার্থীকে আটক করা হয়। এ তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদে একে একে চক্রের সঙ্গে জড়িত অন্যদের নাম বেরিয়ে আসে।

সিআইডির প্রধান শফিকুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মূলত দুভাবে জালিয়াতি হয়। একটি চক্র প্রেস থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে; অন্যটি পরীক্ষা শুরুর কয়েক মিনিট আগে কেন্দ্র থেকে প্রশ্নপত্র নিয়ে দ্রুত তা সমাধান করে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের সরবরাহ করে। পরীক্ষা শুরুর আগেই প্রিন্টিং প্রেস থেকে যে চক্রটি প্রশ্নপত্র ফাঁস করত, তার মূল সদস্য নাটোর জেলার ক্রীড়া কর্মকর্তা রাকিবুল হাসান, প্রেস কর্মচারী খান বাহাদুর, তাঁর আত্মীয় সাইফুল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বনি, মারুফসহ ২৮ জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। এই চক্র ২০১৫ ও ২০১৬ সালেও ফাঁস করা প্রশ্ন নিয়ে সাভারের পল্লী বিদ্যুৎ এলাকার একটি বাসায় ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের পড়িয়েছিল। এ ছাড়া ডিজিটাল ডিভাইস চক্রের অন্যতম সদস্য বিকেএসপির সহকারী পরিচালক অলিপ কুমার বিশ্বাস, ইব্রাহীম, মোস্তফা কামাল, হাফিজুর রহমান হাফিজ ও তাজুল ইসলামও গ্রেপ্তার হয়েছেন।

রাজধানীর ইন্দিরা রোডের পিপলস প্রিন্টিং প্রেস থেকে ঢাবির ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোনো গাফিলতি ছিল কি না, জানতে চাইলে উপাচার্য আখতারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন কখনোই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসে ছাপা হয় না। সংশ্লিষ্ট অনুষদের ডিন সিদ্ধান্ত নেন কোনো ছাপাখানায় ভর্তির প্রশ্ন ছাপা হবে। সিআইডি তাদের তদন্তে ছাপাখানা থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষক বা কর্মচারীর সংশ্লিষ্টতা পায়নি।