চাঁদের কণার জীবন কি ঢেকে যাবে আঁধারে

হুইলচেয়ারে বসে চাকরির জন্য আমরণ অনশন করছেন প্রতিবন্ধী চাঁদের কণা। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে।  ছবি: প্রথম আলো
হুইলচেয়ারে বসে চাকরির জন্য আমরণ অনশন করছেন প্রতিবন্ধী চাঁদের কণা। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে। ছবি: প্রথম আলো

বাবা-মায়ের কোল আলো করে এসেছিলেন তিনি। আদর করে বাবা নাম রাখলেন চাঁদের কণা। কে জানত বছর না ঘুরতে চাঁদের কণার জীবনে নেমে আসবে ঘোর অমাবস্যা। একদিন সেই অমানিশার ঘোর কাটবে—এ প্রত্যয়ে পাড়ি দিয়েছেন জীবনের ৩০ বছর। তবে এবার তাঁর দীর্ঘদিনের সংগ্রাম আর স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। নিরুপায় হয়ে চাঁদের কণা বাঁচার আকুতি নিয়ে আমরণ অনশন করছেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহায়তা চান প্রতিবন্ধী চাঁদের কণা। বাঁচার জন্য চান একটি চাকরি।

সিরাজগঞ্জের প্রতিবন্ধী চাঁদের কণা দুদিন ধরে বাঁচার আকুতি নিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আমরণ অনশন করে যাচ্ছেন। পোলিও রোগ কেড়ে নিয়েছে তাঁর চলনশক্তি। শেষ সম্বল দুই হাত। অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে ২০১৬ সালে ঢাকা ইডেন মহিলা কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। তবে প্রতিবন্ধিতার কারণে যোগ্যতা অনুযায়ী কোথাও চাকরি পাচ্ছেন না চাঁদের কণা।

চাঁদের কণার বাড়িতে উপার্জনক্ষমও কেউ নেই। চোখে দেখছেন অন্ধকার। তাই বাঁচার আকুতি তাঁর প্রধানমন্ত্রীর কাছে। চান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে। নিজ উপার্জনে পরিবারের হাল ধরতে। ‘আমার মা নেই, প্রধানমন্ত্রী আমার মা। তাঁর বুকে একটু আশ্রয় চাই আমি’ লেখা প্ল্যাকার্ডটি তাঁর গলায় ঝোলানো। গত দুই দিন প্রেসক্লাবের সামনে হুইলচেয়ারে বসে নানান প্ল্যাকার্ড নিয়ে অনশনে বসেছেন তিনি।

কথা বলে জানা গেল, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার বিয়াড়া গ্রামের আবদুল কাদেরের মেয়ে চাঁদের কণা। ৯ মাস বয়সে পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে দুটি পা চলনশক্তিহীন হয়ে পড়ে। তখন চিকিৎসক বলেছিলেন, এর কোনো চিকিৎসা নেই। তবে নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে তা সারতে পারে। পরিবারে আর্থিক অভাব-অনটন ছিল। তাই কোনো ফিজিওথেরাপির ব্যবস্থা করা যায়নি। তখন কেবল এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গী দুহাত। হাতে ভর দিয়ে এগিয়ে যাওয়া চাঁদের কণা তাঁর প্রাথমিক স্কুলশিক্ষক মায়ের স্কুলেই স্কুলজীবন শুরু করেন। সেই শুরু। স্কুল ও কলেজজীবন চলতে থাকে নিজের অদম্য ইচ্ছা ও বাবা-মায়ের সহযোগিতায়। ভালোভাবেই চলছিল সব। বিপত্তি ঘটে ২০০৯ সালে। তিনি যখন স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্রী, তাঁর মা হাসনা হেনা বেগম পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। এর কিছুদিন পর তাঁর কলেজশিক্ষক বাবা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে এবং বাবার অসুস্থতাজনিত কারণে তাঁর জীবনে প্রতিবন্ধিতার সঙ্গে নেমে আসে চরম দারিদ্র্য। শত কষ্টের মধ্যেও ২০১৬ সালে ইডেন মহিলা কলেজ থেকে গার্হস্থ্য অর্থনীতিতে প্রথম বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি।

চাঁদের কণা বলেন, সব প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও পড়ালেখার পাশাপাশি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে দক্ষ করে গড়ে তুলেছেন নিজেকে। গান, উপস্থাপনা, সংবাদপাঠ, প্রোগ্রাম প্রোডিউসিং, কম্পিউটারের নানান কাজে দক্ষতা অর্জন করেছেন বলে জানান। এরপর যোগ্যতা অনুযায়ী সরকারি চাকরির জন্য বহু চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু পাননি। এ বছরই তাঁর সরকারি চাকরির বয়স শেষ। বাকি জীবনটা নিয়ে হতাশ তিনি।

চাঁদের কণা আরও বলেন, ছোট দুই ভাইকে নিয়ে তিনি এখন ঘোর অমানিশা দেখতে পাচ্ছেন। একদিকে বাবা অসুস্থ, আর ছোট দুই ভাইয়ের পড়াশোনা বন্ধের উপক্রম। তাই বাধ্য হয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আমরণ অনশনে বসেছেন তিনি।

চাঁদের কণা বলেন, ‘আমিও তো একটা মানুষ। আমার যোগ্যতা আছে। কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধিতার জন্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। জীবনের এই ঘোর সংকটে আজ শুধু বাঁচার আকুতি আমার।’ তিনি বলেন, ‘নিরুপায় হয়ে আজ পথে বসেছি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চাই। আমার কষ্টের কথা, সংগ্রামের কথা তাঁর কাছে বলতে চাই। বলতে চাই আমার জীবনের একটি গতি করে দিন।’