জাতিসংঘের অধীনে শান্তির বার্তা ছড়াতে গিয়েছিলেন তাঁরা

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের প্রথম দুই ব্যাচের সদস্যদের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তারা। স্পেক্ট্রা কনভেনশন সেন্টার, গুলশান-১, ২৭ জুন। ছবি: দীপু মালাকার
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের প্রথম দুই ব্যাচের সদস্যদের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তারা। স্পেক্ট্রা কনভেনশন সেন্টার, গুলশান-১, ২৭ জুন। ছবি: দীপু মালাকার

তিন দশক আগে ৯ হাজার কিলোমিটার দূরের দেশ নামিবিয়ায় শান্তির বার্তা ছড়াতে গিয়েছিলেন তাঁরা। তখন আফ্রিকার ওই দেশটিতে চলছিল গৃহযুদ্ধ। দিন কিংবা রাতে—ঘরের বাইরে কালো চামড়ার মানুষ দেখলেই হামলা, আক্রমণ ও গুলি। এ পরিস্থিতির মধ্যে স্বজন রেখে বাংলাদেশ থেকে যাঁরা ঘর ছেড়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ৩৭ জন জড়ো হয়েছিলেন ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে।

সময়টা ১৯৮৯-৯০ সাল। জাতিসংঘের অধীনে প্রথমবারের মতো শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশ পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ৬০ জন সদস্য। ১১ মাসের সফল মিশন শেষে যখন তাঁরা ঘরে ফিরেছিলেন, এরপর কেটে গেছে তিরিশ বছর। মিশনে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের প্রথম ও দ্বিতীয় ব্যাচের চেনা সেই মুখগুলো মিলিত হয়েছিলেন গতকাল বৃহস্পতিবার। রাজধানীর গুলশানে একটি কনভেনশন সেন্টারে ব্যতিক্রমী এই পুনর্মিলনী আয়োজন করেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ ওয়াই বি আই সিদ্দিকী, যিনি ছিলেন প্রথম শান্তি মিশনের দলনেতা। বয়সের ভারে অনেকটা ন্যুব্জ ওই সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা যেন সজীব, সতেজ হয়ে ওঠেন। ফিরে যান তিন দশক আগের সেই সময়ে। এ আয়োজনে সহযোগিতা করেন তাঁর দুই সহকর্মী সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক কামরুল আহসান, অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক নায়েম আহমেদ।

সাবেক আইজিপি এ ওয়াই বি আই সিদ্দিকীর হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের প্রথম দুই ব্যাচের সদস্যরা। স্পেক্ট্রা কনভেনশন সেন্টার, গুলশান-১, ২৭ জুন। ছবি: প্রথম আলো
সাবেক আইজিপি এ ওয়াই বি আই সিদ্দিকীর হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের প্রথম দুই ব্যাচের সদস্যরা। স্পেক্ট্রা কনভেনশন সেন্টার, গুলশান-১, ২৭ জুন। ছবি: প্রথম আলো

মিশনের অনেকের সঙ্গেই বছর ৩০ পর দেখা। তাই প্রথম পর্বে চলল করমর্দন, বুকে জড়িয়ে ধরা আর ছবি তোলা। শরীরে কেতাদুরস্ত পোশাক, তাতে পদমর্যাদার ব্যাজ লাগানো। এরপরও কারও কারও সাক্ষাৎ আর বুকে জড়িয়ে নেওয়ার মুহূর্তগুলোতে কানে ভেসে আসে, ‘কেমন আছিস? সেই তিরিশ বছর পর দেখা...।’

স্মৃতিচারণায় এ ওয়াই বি আই সিদ্দিকী বলছিলেন, ‘নামিবিয়া তখন অপরিচিত ও দূরের দেশ হওয়ায় দলের সদস্যদের জন্য কঠিন কাজ ছিল দেশটির পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া। শ্বেতাঙ্গরা কোনোভাবেই কৃষ্ণাঙ্গদের দেখতে পারত না। আমরা তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়েছি। বুঝিয়েছি, কালোরাও মানুষ। তাদেরও স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার আছে।’

মিশন শেষে গতকালই প্রথম দেখা হলো সাবেক সহকারী পুলিশ সুপার ইন্তেজার রহমান ও মোস্তাফিজুর রহমানের। নামিবিয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনায় ইন্তেজার রহমান বলছিলেন, যুদ্ধ চলায় মিশনের শুরুর দিকে ভয় কাজ করত। রাস্তায় নামলেই এদিক-সেদিক থেকে গুলি ছুটে আসত। একবার রাতে পেট্রল ডিউটি শেষে ক্যাম্পে ফেরার পথের ঘটনা, আমাদের গাড়ি শ্বেতাঙ্গদের একটি এলাকা পার হওয়ার সময় চারপাশ থেকে মুহুর্মুহু ফাঁকা গুলি ছোড়া হয়। মাথায় তখন বেঁচে ফিরতে পারব কি না সেই চিন্তা। শেষমেশ নিজেদের পরিচয় দিয়ে ওই যাত্রায় রক্ষা পেয়েছিলাম। মিশনের দিনগুলো ছিল এমনই। বিপদে সবাই সবার পাশে থাকতাম।

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের প্রথম দুই ব্যাচের সদস্যদের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন সাবেক আইজিপি এ ওয়াই বি আই সিদ্দিকী। স্পেক্ট্রা কনভেনশন সেন্টার, গুলশান-১, ২৭ জুন। ছবি: প্রথম আলো
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের প্রথম দুই ব্যাচের সদস্যদের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন সাবেক আইজিপি এ ওয়াই বি আই সিদ্দিকী। স্পেক্ট্রা কনভেনশন সেন্টার, গুলশান-১, ২৭ জুন। ছবি: প্রথম আলো

অনুষ্ঠানে যোগ দেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন, ডেনমার্কসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকেরা। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শকদের মধ্যে ছিলেন এনামুল হক, আজিজুল হক, মোদাব্বের হোসেন চৌধুরী ও এ টি এম আহমেদুল হক চৌধুরী। সাবেক সচিবদের মধ্যে ছিলেন আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী, হুমায়ুন কবীর প্রমুখ। আরও ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান, অধ্যাপক মনসুর মুসা প্রমুখ। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সেই সময়ের প্রতিবেদক এবং পরবর্তী সময়ে বাসসের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হারুন হাবীব অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণা করেন। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন শম্পা রেজা। এ ওয়াই বি আই সিদ্দিকীর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে তাঁর সহধর্মিণী ও শিল্পী রেহানা সিদ্দিকী, ছেলে লুৎফে সিদ্দিকী এবং মেয়ে হুসনা সিদ্দিকী লওসন আমন্ত্রিত অতিথিদের অভ্যর্থনা জানান।

নামিবিয়ার শান্তি মিশনে অংশ নিয়ে সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা আহমেদ আমিন চৌধুরী লিখেছেন নামিবিয়ার স্বাধীনতায় আমরা এবং দেশটির স্বাধীনতা অর্জনের মুহূর্ত দেখার ঘটনা নিয়ে সাংবাদিক হারুন হাবীব লিখেছেন সূর্যোদয় দেখে এলাম। বই দুটি দেখা যায় কারও কারও হাতে।

পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিরা। স্পেক্ট্রা কনভেনশন সেন্টার, গুলশান-১, ২৭ জুন। ছবি: প্রথম আলো
পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিরা। স্পেক্ট্রা কনভেনশন সেন্টার, গুলশান-১, ২৭ জুন। ছবি: প্রথম আলো

গৃহযুদ্ধ শেষে ১৯৮৯ সালের ৭ থেকে ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয় নামিবিয়ার প্রথম সংসদীয় নির্বাচন। সেখানেও দায়িত্ব পালন করেন শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা। গতকাল তাই মিশনের সদস্যদের পুনর্মিলনীও শুরু হলো নামিবিয়ার প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট স্যাম নুয়োমার শুভেচ্ছা বক্তব্য দিয়ে। ভিডিও বার্তায় তিনি বললেন, নামিবিয়ার মুক্তির প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশি সদস্যরা অসাধারণ অবদান রেখেছেন। এটি ভোলার মতো নয়।

ভিন্ন মহাদেশের ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ। তিরিশ বছর কম সময় নয়। এরপরও নামিবিয়ার মানুষ মনে রেখেছে, তিরিশ বছর আগের সংকটের সময় কয়েকজন বাংলাদেশি তাদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন।