ব্রুসেলোসিস রোগের জীবাণু শনাক্ত ও জীবনরহস্য উন্মোচন

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মো. আরিফুল ইসলাম। ছবি: মো. শাহীদুজ্জামান
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মো. আরিফুল ইসলাম। ছবি: মো. শাহীদুজ্জামান

ব্রুসেলোসিস ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রামক রোগ। এটি এমন একটি ছোঁয়াচে জুনোটিক রোগ, যা পশু থেকে মানুষে এবং মানুষ থেকে পশুতে ছড়ায়। গবাদিপশুর ভ্রূণ নষ্ট, অকালে গর্ভপাত, বন্ধ্যত্ব এবং মানুষ ও পশু-পাখির মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায় এই রোগ। দেহে রোগের অ্যান্টিবডির উপস্থিতির মাধ্যমে এ রোগ নির্ণয় করা গেলেও বাংলাদেশে এ রোগের জন্য ঠিক কোন জীবাণু দায়ী, তা এর আগে শনাক্ত হয়নি।

দেশে প্রথমবারের মতো গরুতে ব্রুসেলোসিস রোগের জীবাণু শনাক্ত ও এই ব্যাকটেরিয়ার জীবনরহস্য (জিনোম সিকোয়েন্স) উন্মোচনের দাবি করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আরিফুল ইসলাম। আজ শনিবার নিজ বিভাগে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ তথ্য জানান। বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি ও যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের অর্থায়নে গত তিন বছর তিনি এ গবেষণা করেন।

আরিফুল ইসলাম বলেন, প্রাণী ও মানবদেহে ব্যাকটেরিয়াজনিত ছোঁয়াচে রোগগুলোর মধ্যে সংক্রমণের দিক থেকে যক্ষ্মা ও অ্যানথ্রাক্সের পরেই ব্রুসেলোসিসের অবস্থান। গর্ভপাত ও মৃত্যুর ঝুঁকি থাকায় খামারিরা ব্যাপকভাবে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। আক্রান্ত পশুর শরীরে রোগের অ্যান্টিবডির উপস্থিতি নির্ণয়ের মাধ্যমে বর্তমানে দেশে ব্রুসেলোসিস রোগ শনাক্ত করা হচ্ছে। কিন্তু ওই অ্যান্টিবডির উপস্থিতি শুধু ব্রুসেলোসিস নয়, সালমোনেলা, কোলিবেসিলোসিস কিংবা ইয়ারসিনিয়া রোগের জীবাণুও নির্দেশ করে। এ কারণে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এ রোগ নির্ণয় সম্ভব হয় না।

গবেষক বলেন, আক্রান্ত গাভির রক্তের সিরাম, মূত্র ও দুধ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণা করা হয়। গরুতে ব্রুসেলোসিস রোগ সৃষ্টিকারী প্রধান জীবাণু ব্রুসেলা অ্যাবরটাস (Brucella abortus) ব্যাকটেরিয়া। এই ব্যাকটেরিয়ার নয়টি অ্যান্টিজেনিক ভ্যারিয়েশন আছে, যাকে বলে বায়োভার (biovar)। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সংগৃহীত নমুনার সব কটিতেই বায়োভার-৩ পেয়েছি। সুতরাং, এখন পর্যন্ত এটিই বাংলাদেশে গরুতে ব্রুসেলোসিস রোগের জন্য দায়ী।’

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, মানুষ যেসব রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়, এর ৭৫ শতাংশই আসে গবাদিপশু থেকে। এদের মধ্যে অন্যতম যক্ষ্মা, জলাতঙ্ক, ব্রুসেলোসিস, অ্যানথ্রাক্স, নিপা ও অ্যাভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা। এসব রোগবালাইয়ের কারণে বছরে ৩৫ থেকে ৫০ শতাংশ উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, সম্প্রতি সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিরাময় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) ছয়টি সংক্রামক রোগের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা নিতে বলেছে, যার মধ্যে একটি হলো ব্রুসেলোসিস।

অণুবীক্ষণ যন্ত্রে বাংলাদেশের গরুতে ব্রুসেলোসিস সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া জীবাণু।
অণুবীক্ষণ যন্ত্রে বাংলাদেশের গরুতে ব্রুসেলোসিস সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া জীবাণু।

জীবাণু শনাক্তের পাশাপাশি এই ব্যাকটেরিয়ার জিনোম সিকোয়েন্স সম্পন্ন করেছেন গবেষক, যাতে ভবিষ্যতে অধিকতর গবেষণা করে বাংলাদেশে এ রোগ নিরাময়ে ভ্যাকসিন (টিকা) তৈরি করা যায়। জিনোম হচ্ছে কোনো প্রজাতি বা জীবের মোট নিউক্লিওটাইড সমষ্টি। অর্থাৎ কোনো জীবের পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। এ জীবাণুর জিনের তথ্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশনের (এনসিবিআই) তথ্যভান্ডার থেকে ইতিমধ্যে নিবন্ধিত হয়েছে। তা ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ‘মাইক্রোবায়োলজি রিসোর্স অ্যানাউন্সমেন্ট’ সাময়িকীতে গবেষণাটি প্রকাশিতও হয়েছে।

আরিফুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে ছাড়াও মালয়েশিয়া ও ইতালির কিছু ল্যাবে জীবাণু শনাক্তকরণ ও জিন সিকোয়েন্সের কাজ করা হয়েছে। এই গবেষণাকে কাজে লাগিয়ে ভ্যাকসিন তৈরি ও উন্নত বায়োমেডিক্যাল গবেষণা সম্ভব হবে। এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হলে খামারি ও উদ্যোক্তাদের ক্ষতির হার ও মানুষের আক্রান্ত ও মৃত্যুহার অনেকাংশে কমে যাবে।

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) মহাপরিচালক নাথু রাম সরকার প্রথম আলোকে বলেন, যেহেতু ব্রুসেলোসিস মানুষ ও পশু-পাখি উভয়েই ছড়ায়, তাই এর আলাদা গুরুত্ব তো রয়েছেই। এখন ভ্যাকসিন তৈরি করতে পারলে নিঃসন্দেহে দেশের প্রাণিসম্পদের জন্য ভালো হবে।