ক্ষতস্থানে সংক্রমণ না হলে শঙ্কামুক্ত ফিরোজ, মামলা-মানববন্ধন

এক বাসের সঙ্গে আরেক বাসের ধাক্কায় হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে ফিরোজ সরদারের। পরে তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। রাজশাহী, ২৮ জুন। ছবি: প্রথম আলো
এক বাসের সঙ্গে আরেক বাসের ধাক্কায় হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে ফিরোজ সরদারের। পরে তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। রাজশাহী, ২৮ জুন। ছবি: প্রথম আলো

যাত্রীবাহী বাসটি রাজশাহীর পুঠিয়ায় এসে বেপরোয়া গতিতে চালাতে থাকে। কলেজছাত্র ফিরোজ সরদার এই বাসের পেছনের আসনে বসে সামনের একটি আসন ধরেছিলেন। বাসটি কাটাখালী এলাকায় পৌঁছলে আরেকটি বাসের সঙ্গে ধাক্কা খায়। ধাক্কা লাগার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ডান হাত কনুইয়ের ওপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জানালা দিয়ে রাস্তায় পড়ে যায়।

এভাবেই নিজের হাত বিচ্ছিন্ন হওয়ার বর্ণনা দিলেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন ফিরোজ। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ক্ষতস্থানে সংক্রমণ না হলে শঙ্কামুক্ত ফিরোজ। এদিকে এ ঘটনায় ফিরোজের বাবা মামলা করেছেন।

ফিরোজ যে গাড়িতে আসছিলেন, সেটির ইংরেজিতে নামের প্রথম দুই অক্ষর ‘এম, ও’ বলে জানান। এ ছাড়া গাড়িতে ওঠার সময় খেয়াল করেছিলেন গাড়ির সামনের কাচ ছিল ফাটা। আর গাড়ির দরজার সঙ্গে যে জানালা থাকে তার একটিতে কোনো কাচ ছিল না। ফিরোজ জানান, নন্দীগ্রামে বাসে ওঠার সময় চেইন মাস্টার তাঁকে জানিয়েছিলেন, গাড়িটি বগুড়া থেকে আসছিল। আজ শনিবার সকাল থেকেই রাজশাহীতে ছড়িয়ে পড়ে ‘মোহাম্মদ’ নামের বাসে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। আজ দুপুরে মোহাম্মদ বাসটিকে রাজশাহী নগরের শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান বাস টার্মিনালের পশ্চিম পাশে দেখা গেছে। গাড়ির কোনো লোক পাওয়া যায়নি। টার্মিনালের লোকজন জানিয়েছেন, বগুড়া-রাজশাহীর মধ্যে চলাচলকারী বাসের এই টার্মিনালে রাখার কথা নয়। এই গাড়ি ট্রিপ শেষে নগরের নওদাপাড়া টার্মিনালে এনে রাখা হয়। স্থানীয় লোকজনের ধারণা ঝামেলা এড়াতে বাসটিকে এই টার্মিনালে রাখা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই বাসের মালিক সেরেকুল হাজি। কথা বলার জন্য সেরেকুলের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। এই গাড়ির ছবি তুলে নিয়ে গিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ফিরোজকে দেখালে তিনি গাড়িটি শনাক্ত করেন। তিনি বলেন, এই গাড়িতেই তিনি গত শুক্রবার নন্দীগ্রাম থেকে উঠেছিলেন।
ফিরোজ বলেন, আসার পথে নাটোর পর্যন্ত বাসটি অনেক জায়গায় থেমেছে আর দেরি করেছে। রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলা সদর পার হওয়ার পর বাসের গতি বাড়তে থাকে। পুঠিয়ার বেলপুকুর থেকে খুবই বেপরোয়া গতিতে চলছিল। দুটি গাড়ির চালকের দোষে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাই দুই চালকের শাস্তি চান তিনি।
ফিরোজ জানান, তিনি বাসের একেবারে শেষের সিটে বসে ছিলেন। ডান হাত দিয়ে তিনি জানালার ভেতর দিয়েই সামনের সিট ধরে ছিলেন। হঠাৎ একটা ঝাঁকুনিতে তার হাত সিট থেকে আলাদা হয়ে জানালার বাইরে চলে যায়। তখনই বিকট শব্দে পাশের গাড়ির সঙ্গে বাসটি ধাক্কা খায়। এতে চাপা পড়ে তার হাত কেটে পড়ে যায়। হাত কেটে যাওয়ার পরও হাসপাতাল আসা পর্যন্ত তাঁর চেতনা ছিল। কিন্তু যে গাড়ির সঙ্গে চাপা লেগে তার হাত বিচ্ছিন্ন হয়েছে সেটি তিনি চিনতে পারেননি।

মানববন্ধন:
দুপুর ১২টায় রাজশাহী কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ফিরোজের হাত বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘটনার জন্য দোষীদের শাস্তি দাবি করে মানববন্ধন করেছেন। এই সময় কলেজের অধ্যক্ষ হবিবুর রহমান বলেছেন, পুলিশ এখনো পর্যন্ত গাড়ি শনাক্ত করতে পারেনি। এটা পুলিশের পাঁচ মিনিটের কাজ। শিক্ষার্থীরা বলেন, বাস মালিককের এই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তা ছাড়া কলেজ চত্বরের এই মানববন্ধন নগরের রাস্তায় চলে যাবে। মানববন্ধনে ফিরোজ সরদারের বড় ভাই আরিফুল ইসলাম ছিলেন। তিনি সরকারের কাছে তাঁর ভাইয়ের কর্মসংস্থান দাবি করেন।

মামলা:
ফিরোজের বাবা মাহফুজ আর রহমান শনিবার বিকেলে বাদী হয়ে রাজশাহী নগরের কাটাখালী থানায় মামলা করেছেন। এ মামলায় আসামি হিসেবে কারও নাম উল্লেখ করা হয়নি। পুলিশ তখন পর্যন্ত গাড়ি শনাক্ত করতে পারেনি।

কাটাখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিবারণ চন্দ্র বর্মণ আজ বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, তারা বাস শনাক্ত করতে মাঠে নামবেন। মোহাম্মদ পরিবহনের বর্ণনা শুনে তিনি বলেন, তারা ওই গাড়িটাকেই সন্দেহ করছেন।

ফিরোজরা তিন ভাই-বোন। তাদের বাবা কৃষক। তার কয়েক বিঘা জমি আছে। ফিরোজের বড় ভাইয়ের প্রসাধনসামগ্রীর দোকান আছে নন্দীগ্রাম উপজেলা সদরে। ফিরোজ ২০১০ সালে নন্দীগ্রাম পাইলট হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক, ২০১২ সালে নাটোরের সিংড়া দমদমা পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং বগুড়ার সৈয়দ আহমেদ কলেজ থেকে ২০১৭ সালে সমাজকর্ম বিভাগ থেকে ¯স্নাতক পাস করেছেন। এরপর স্নাতকোত্তরে ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। ২২ জুন তাঁর স্নাতকোত্তর পরীক্ষা শুরু হয়েছে। তিনি প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা দিতে বাড়িতে গিয়েছিলেন।

তার বড় ভাই আরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সবার ছোট ফিরোজকে নিয়ে তাদের পরিবারের বড় স্বপ্ন ছিল। সে স্বপ্ন এখন ফিকে। চিকিৎসক তাদের জানিয়েছেন, শরীরের হাত ছাড়া কোথাও কোনো সমস্যা নেই। হাতের কাটা অংশ যদি এখন শুকিয়ে যায় তাহলে কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু এতে যদি এখন ইনফেকশন দেখা দেয় তাহলে বিপদ। এ জন্য উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। তিনি বলেন, আমরা চাই সরকার ফিরোজের চিকিৎসার ব্যবস্থা করুক। আর সুস্থতার পর যেন তার একটা চাকরির ব্যবস্থা করা হয়। এর পাশাপাশি দোষী চালকদেরও যেন শাস্তি নিশ্চিত হয়।