প্রশ্নপত্র ফাঁস করে কোটিপতি তারা

আসামি (বাঁ থেকে) হাফিজুর, অলিপ ও ইব্রাহীম। ছবি: সংগৃহীত
আসামি (বাঁ থেকে) হাফিজুর, অলিপ ও ইব্রাহীম। ছবি: সংগৃহীত

আট বছর ধরে বিসিএসসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে কোটিপতি হয়েছে আট সদস্যের সংঘবদ্ধ প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্র। চক্রের এসব সদস্য রাতারাতি বড়লোক বনে গেছেন। কিনেছেন দামি গাড়ি ও জমি, বানিয়েছেন বাড়ি। এই ৮ আসামির ব্যাংক হিসাবগুলোয় প্রায় সাড়ে ১২ কোটি টাকার লেনদেনের প্রমাণ পেয়েছে পুলিশের অপরাধ ও তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

সম্প্রতি সিআইডি প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্রের এই ৮ জনসহ ১২৫ জনের বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (অর্গানাইজড ক্রাইম) মোল্লা নজরুল ইসলাম শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্রের এই সদস্যরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র, বিসিএসসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কয়েক বছর ধরে ফাঁস করে কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন। প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্রের অন্যতম ৮ সদস্যের ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনায় তার প্রমাণ মিলেছে। তাঁদের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার আইনে মামলাও হয়েছে।

অর্থ পাচার মামলার আট আসামি হলেন জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা চাঁপাইনবাবগঞ্জের হাফিজুর রহমান, বিসিএস নন-ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত গোপালগঞ্জের ইব্রাহীম, বিকেএসপির সহকারী পরিচালক রাজবাড়ীর অলিপ কুমার বিশ্বাস, বিএডিসির সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা সিরাজগঞ্জের মোস্তফা কামাল, নাটোর জেলার ক্রীড়া কর্মকর্তা পাবনার রাকিবুল হাসান, ব্যবসায়ী তাজুল ইসলাম এবং সাতক্ষীরার রিমন হোসেন।

২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর গণমাধ্যমকর্মীদের দেওয়া তথ্যের সূত্র ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল থেকে ছাত্রলীগের নেতা মহিউদ্দিন রানা এবং অমর একুশে হল থেকে আবদুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। তাঁদের তথ্যের ভিত্তিতে পরদিন পরীক্ষার হল থেকে ইশরাক হোসেন নামের এক পরীক্ষার্থীকে আটক করা হয়। এরপর প্রায় দুই বছর তদন্ত করে সিআইডি প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্রের ৪৭ জনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের মধ্যে ৪৬ জনই ঢাকার আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

কার ব্যাংকে কত টাকা
ভর্তি ও নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতির মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ আয় করার অভিযোগে প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্রের ৮ জনের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার আইনে গত ৭ জানুয়ারি মামলা করে সিআইডি।
মামলার এজাহারে বলা হয়, গত সাত থেকে আট বছর ধরে সংঘবদ্ধভাবে এসব আসামি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাসহ ব্যাংক, বিসিএস ও অন্যান্য সরকারি চাকরি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছে। ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে জালিয়াতি করে বাড়ি, গাড়ি, জমিসহ বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন।

আসামিদের স্বীকারোক্তি এবং মামলার এজাহারের তথ্য বলছে, জনতা ব্যাংক কর্মকর্তা হাফিজুর রহমানের উত্তরার প্রাইম ব্যাংকের হিসাবে (২০১০ সাল থেকে ২০১৭) ২ কোটি ১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা জমা হয়েছে। অপর দিকে হাফিজুরের উত্তরার সিটি ব্যাংকের হিসাবে ২ কোটি ৬৯ লাখ ৫৫ হাজার ৬৯৩ টাকার লেনদেন হয়েছে (২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সালের ২২ এপ্রিল পর্যন্ত)। জনতা ব্যাংকে হাফিজুরের ব্যাংক হিসাবে ৪ কোটি ৭১ লাখ ৪১ হাজার ৭৫১ টাকা জমা হয়েছে।

আসামি ইব্রাহীমের সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, ধানমন্ডি শাখায় ২৮ লাখ ৩৮ হাজার ৫১৫ টাকা, ডাচ্‌–বাংলা ব্যাংক, যশোর শাখায় ৩৫ লাখ ৯৮ হাজার ১৪৫ টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক, এলিফ্যান্ট রোড শাখায় ১ কোটি ৫১ লাখ ৯৮ হাজার ৯৯৩ টাকা জমা রাখা হয়। এ ছাড়া ইব্রাহীমের স্ত্রীর উত্তরা ব্যাংক, নড়াইল শাখায় ১ কোটি ৩৯ লাখ ৬১ হাজার ৫২৬ টাকা জমা রাখা হয়। অর্থাৎ ইব্রাহীমের ব্যাংক হিসাবে মোট ৩ কোটি ৫৫ লাখ ৯৭ হাজার ১৭৯ টাকার লেনদেন হয়েছে। ইব্রাহীম আদালতের কাছে স্বীকার করেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে অবৈধভাবে আয় করা টাকা দিয়ে হোন্ডা ভেজেল গাড়ি কেনেন।

বিকেএসপির কর্মকর্তা অলিপ বিশ্বাসের মার্কেন্টাইল ব্যাংকের, এলিফ্যান্ট রোড শাখার হিসাবে ১৪ লাখ ৪০ হাজার ৩৮৫ টাকা, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের আরেকটি হিসাবে ১ কোটি ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯৮৯ টাকা, ব্র্যাক ব্যাংকে ২১ লাখ টাকা, জনতা ব্যাংকে ৩৯ লাখ ৩৩ হাজার ৫১৪ টাকা, উত্তরা ব্যাংকে ৪০ লাখ ৮৬ হাজার ৩৬৫ টাকা, ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক শাখায় ৩৫ লাখ এবং রূপালী ব্যাংকে ৩৫ লাখ ৪০ হাজার ৫৯৩ টাকা জমা করেছেন। এ ছাড়া অলিপ বিশ্বাস ব্র্যাক ব্যাংকের এলিফ্যান্ট রোড শাখায় মায়ের নামে ৭০ লাখ এফডিআর করেছেন। মোট অলিপ এবং তাঁর মায়ের হিসাবে ৩ কোটি ২৯ লাখ ২৪ হাজার ২৬২ টাকার লেনদেন হয়েছে।

বিএডিসির কর্মকর্তা মোস্তফা কামালের ব্যাংক হিসাবের তথ্য বলছে, ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক, সাতমসজিদ রোড শাখায় ১৫ লাখ ৭ হাজার ৪১৬ টাকা, ইসলামী ব্যাংকের, মিরপুর শাখায় ১৭ লাখ ৭৩ হাজার ৩১৩ টাকার লেনদেন হয়েছে।

এ ছাড়া নাটোরের ক্রীড়া কর্মকর্তা রাকিবুল হাসানের হিসাবে ২৬ লাখ ৭০ হাজার ৪৭ টাকা, ৩৮তম বিসিএসে উত্তীর্ণ আয়ুব আলীর ব্যাংক হিসাবে ৬০ লাখ টাকা জমা হয়েছে।

আসামি (বাঁ থেকে) মোস্তফা, রাকিবুল, তাজুল। ছবি: সংগৃহীত
আসামি (বাঁ থেকে) মোস্তফা, রাকিবুল, তাজুল। ছবি: সংগৃহীত

চক্রের প্রধানদের স্বীকারোক্তি
হাফিজুর একসময় চাকরি করতেন বিমানবাহিনীতে। ২০১৩ সালে বিমানবাহিনীর চাকরি ছেড়ে জনতা ব্যাংকে চাকরি নেন। ২০১৪ সালে বিএডিসির কর্মকর্তা মোস্তফার সঙ্গে পরিচয় হয়। আসামি মোস্তফার কথামতো গুদামরক্ষক পদে শাহীনের কাছ থেকে ৫ লাখ, আরাফাতের কাছ থেকে ৪ লাখ, কামালের কাছ থেকে ৩ লাখ এবং নাহিদের কাছ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা নেন। উত্তরা ব্যাংকের ক্যাশিয়ার পদে জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার জন্য ইমন, জাহাঙ্গীর, শাহীন এবং আরাফাতের কাছ থেকে মোট সাড়ে ১১ লাখ টাকা নেন। ২০১৬ সালের প্রথম দিকে মোস্তফার মাধ্যমে অলিপ বিশ্বাস, ইব্রাহীম, আইয়ুব আলী, তাজুল ইসলামের সঙ্গে পরিচয় হয়। এঁরা নিয়োগ পরীক্ষার পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ডিভাইসের মাধ্যমে ফাঁস করতেন। ২০১৭ সালের বিজেএমসির টাইম কিপার পদে নিয়োগের জন্য কবিরের কাছ থেকে ৫ লাখ, সেরাজুলের কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা নেন। ২০১৭ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরো চাকরির জন্য সেফাউলের কাছ থেকে ৫ লাখ, রুবেলের কাছ থেকে ৩ লাখ টাকা নেন। ২০১৭ সালে মেডিকেল নার্স নিয়োগ পরীক্ষায় শিউলি, পারভীন, ইশতিয়াক ও ইয়াসিনের কাছ থেকে মোট ১৫ লাখ টাকা নেন।

ইব্রাহীম ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, মোস্তফা কামালের সাইফুরসে ক্লাস নেওয়ার সময় তাঁর পরিচয়। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক, কৃষি ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংকের অফিসার পদে এবং পরিসংখ্যান ব্যুরোর অপারেটর, এলএমএসএস, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এলএমএসএস, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, ব্লক সুপারভাইজার পদে, কৃষি উন্নয়ন বোর্ডের তৃতীয় শ্রেণির নিয়োগের প্রশ্নপত্র ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে বহু লোকের চাকরি দেন। মোস্তফা ধানমন্ডি বয়েজ স্কুলের পিয়ন হাসমতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। হাসমত পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে প্রশ্নফাঁস করতেন। অগ্রণী স্কুলের পিয়ন আনোয়ারও একই কাজ করতেন। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পরীক্ষায় নিয়োগ ও ভর্তি জালিয়াতির মাধ্যমে ৬০ জনের বেশি লোককে নিয়োগ দিয়ে ১ কোটি টাকা আয় করেন। জালিয়াতির মাধ্যমে আয় করা টাকা নিজের এবং স্ত্রীর হিসাবে লেনদেন করেন। এই টাকা দিয়ে গ্রামের বাড়িতে ৫ বিঘা জমি, ১০ কাঠা জমির ওপর একটা দোতলা বাড়ি, খুলনার মুজগুন্নী আবাসিক এলাকায় সাড়ে ৬ শতাংশ জমির ওপর চার তলা বাড়ি এবং একটি হোন্ডা ভেজেল গাড়ি কেনেন।

বিকেএসপির কর্মকর্তা অলিপ বিশ্বাস জবানবন্দিতে বলেন, ২০১৬ সালে ইব্রাহীম ইডেন কলেজের নেত্রী অনুর সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ক’ ইউনিটের প্রশ্নপত্র পাওয়ার বিষয়ে কথা বলেন। পরীক্ষার দিন ইব্রাহীমের কথামতো তিনি (অলিপ) এবং বাধন ইডেনে প্রশ্নপত্র আনতে যান। পরীক্ষা শুরু হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাধন প্রশ্ন নিয়ে আসেন। ওই প্রশ্ন নিয়ে এফ রহমান হলের সোহানের রুমে যান। সেখানে বসে প্রশ্নের সমাধান করা হয়। প্রশ্নপত্রের সমাধানের ছবি মোবাইলে ধারণ করেন। ওই ছবি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের খালিদ, শাকিল, রুবেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের মহিউদ্দিন রানা, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের প্রণয় পাণ্ডে, ঢাকা কলেজের জাহাঙ্গীর আলমের কাছে পাঠান। ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক, ঘ ইউনিটের প্রশ্নপত্র হাফিজ অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজের পিয়ন আনোয়ারের কাছ থেকে নিয়ে আসেন। তা সমাধান করা হয়। অনেক পরীক্ষার্থী চান্স পান।

অলিপ জবানবন্দিতে আরও বলেন, ২০১৪ সালে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস করেন। ২০১৪ সালে ঢাকা কলেজের মনিরের কাছ থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের খ ইউনিটের পরীক্ষার উত্তরপত্র এসএমএসের মাধ্যমে সংগ্রহ করেন। ২০১৮ সালের জনতা ও কৃষি ব্যাংকের প্রিলিমিনারি অংশের উত্তর তাজুলের কাছ থেকে সংগ্রহ করে তা প্রণয় পাণ্ডে এবং জাহাঙ্গীর আলমকে দেন। রাজবাড়ী জেলার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের প্রশ্নপত্রের উত্তর এসএমএসের মাধ্যমে রুবেলের কাছ থেকে নেন। কয়েকজনকে তা সরবরাহ করেন।

আসামি আয়ুব আলী ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে বলেন, ২০১৭ সালে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নিয়োগ পরীক্ষার সময় ধানমন্ডি স্কুলের পিয়ন হাসমতের কাছে যান। সকাল ১০টা ১০ মিনিটে প্রশ্নপত্রের ছবি তুলে তা ইব্রাহীম এবং মানস পান্ডের কাছে পাঠান। ২০১৭ সালের ঘ ইউনিটের পরীক্ষার দিন প্রশ্নপত্র অগ্রণী স্কুলের আনোয়ারের কাছ থেকে নিয়ে আসেন। ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষায় তিনি নিজে অংশ নেন। ইব্রাহীমের আইডি থেকে উত্তরপত্র আসে। সেই উত্তর পেয়ে তিনি এবং রাসেল উত্তীর্ণ হন।

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্লা নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, জালিয়াতির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র এবং নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসকারী চক্রের অন্যতম ৮ জনের বিরুদ্ধে হওয়া অর্থ পাচার মামলার তদন্ত চলমান। প্রশ্নপত্র ফাঁস করে অবৈধভাবে আয় করা চক্রের সব সদস্যকে চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করা হবে।