কাজ শেষের চার মাস পরও মিলছে না বিল

আহমদ আলী। নলুয়ার হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে গঠিত ৬ নম্বর প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) সভাপতি। গত ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ওই প্রকল্পের কাজ শেষ করার চাপ ছিল প্রশাসনের। হাতে টাকা না থাকায় ধারদেনা করে সেই কাজ শেষ করেন। কিন্তু বিল পেয়েছেন মাত্র ৬০ শতাংশ কাজের। বোরো ফসল উঠলে বাকিটা ছাড় করার কথা ছিল। তিন মাস আগে সেই ফসল কৃষকের ঘরে উঠলেও বাকি ৪০ শতাংশের বিল আজও পাননি।

সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলার কবিরপুর গ্রামের বাসিন্দা আহমদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ৩ লাখ টাকা ধারদেনা করেছি। প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই বাঁধের কাজ শেষ করেছি।সবাই আমার প্রকল্পের কাজের প্রশংসাও করেছেন। আশা ছিল, এপ্রিল মাসে ধান ওঠার পর চূড়ান্ত বিল পেয়ে যাব। সেটা পেলে সব ঋণ শোধ করে দিতে পারতাম। কিন্তু আজও বিল পাইনি। পাওনাদারেরা বাড়িতে আসছেন। তাঁদের ভয়ে এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছি।’

শুধু আহমদ আলীই নন। তাঁর মতো অবস্থা জগন্নাথপুরের সব কটি পিআইসির সভাপতি, সদস্যসচিব ও সদস্যদের। প্রকল্পের কাজ সেই ফেব্রুয়ারিতে শেষ হলেও কেউই এখনো ৬০ শতাংশের বেশি বিল পাননি। ফলে বিপাকে আছেন তাঁরা। কারণ এই কাজে সম্পৃক্ত বেশির ভাগ মানুষই কৃষক। অন্যরা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। দরিদ্র হওয়ায় কারোরই নিজের টাকায় প্রকল্পের কাজ শেষ করার সক্ষমতা ছিল না।

বাঁধের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত লোকজন ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, জগন্নাথপুর উপজেলার নলুয়ার হাওর জেলার মধ্যে অন্যতম বৃহৎ। এখানে প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণে বোরো ফসলের আবাদ হয়। কিন্তু বন্যার কারণে কৃষকেরা ঠিকমতো সেই ফসল ঘরে তুলতে পারেন না। বন্যার হাত থেকে ফসল রক্ষায় এবার নলুয়ার হাওরে ৫০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির মাধ্যমে বাঁধের কাজ করা হয়। নীতিমালা অনুযায়ী, গত ১৫ ডিসেম্বর থেকে কাজ শুরু হয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। এবার মোটামুটি যথাসময়ে কাজ শেষ হয়েছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় কাজের মানও ভালো।

নলুয়ার হাওরবেষ্টিত চিলাউড়া হলদিপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আরশ মিয়া বলেন, আগে বাঁধের কাজ হতো ঠিকাদারি প্রথায়। তখন বাঁধের কাজে অনেক লুটপাট হতো। আবার ৩০ জুনের মধ্যে ঠিকাদারেরা সব বিল তুলে নিয়ে যেতেন। পিআইসি প্রথায় কাজ শুরুর পর পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। এখন বাঁধের কাজে যুক্ত থাকেন এলাকার কৃষক ও জনপ্রতিনিধিরাই। হাওরে তাঁদেরও জমি আছে। বাঁধ ভালো না হলে তাঁদের ফসলও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে নিজেদের প্রয়োজনেই তাঁরা ভালো করে বাঁধের কাজ করেন। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে, বাঁধের কাজে যুক্ত এসব প্রান্তিক কৃষক ও জনপ্রতিনিধির প্রায় সবাই দরিদ্র। তাই ধারদেনা করেই কাজ করেছেন। কিন্তু এত দিনেও পুরো বিল পাননি, এটা দুঃখজনক।

এদিকে গত বছর পর্যন্ত ফসল রক্ষা বাঁধের কাজের বিল যেভাবে দেওয়া হয়েছে, এবার সেভাবে দেওয়া হয়নি। আগে চার কিস্তিতে সমান ২৫ শতাংশ করে কাজের বিল দেওয়া হতো। এবার প্রতি কিস্তিতে দেওয়া হয়েছে ২০ শতাংশ করে। বাঁধের কাজ শুরুর পর গত ১৫-২০ জানুয়ারির মধ্যে প্রথম কিস্তির, ৭-১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে দ্বিতীয় কিস্তির এবং ৭-১৫ মার্চের মধ্যে তৃতীয় কিস্তির টাকা ছাড় করা হয়। সব মিলিয়ে তিন দফায় ৬০ শতাংশ কাজের বিল পেয়েছে পিআইসিগুলো।

নলুয়ার হাওরের ১৪ নম্বর প্রকল্পের সভাপতি জুয়েল মিয়া বলেন, ‘বাঁধের কাজ যথাসময়ে শেষ করার জন্য আমাদের ওপর চাপ দেওয়া হয়েছিল। ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ তদারক কমিটির সদস্যরা সময়ে সময়ে এসে কাজ দেখেছেন। কাজের অগ্রগতি কম হলে বা মান খারাপ হলে নানা কথা বলেছেন। কিন্তু এখন শতভাগ কাজ শেষ করার পরও বিল দেওয়া হচ্ছে না। নির্ধারিত সময়ের পর তিন মাস গেলেও চূড়ান্ত বিল আটকে রাখার বিষয়টি দুঃখজনক।’

হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ তদারক কমিটির উপজেলা সভাপতির দায়িত্বে থাকা জগন্নাথপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহফুজুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, বাঁধের কাজের চূড়ান্ত বিল দেওয়ার জন্য জেলার মাসিক সমন্বয় সভায় আলোচনা হয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ ছাড় না হওয়ায় চূড়ান্ত বিল দেওয়া যাচ্ছে না।