বৃথা যায়নি ফারাজের আত্মত্যাগ

ফারাজ আইয়াজ হোসেন।
ফারাজ আইয়াজ হোসেন।

প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটিটিসি) উপকমিশনার আবদুল মান্নান বলেছিলেন, ‘হোলি আর্টিজান হামলায় একমাত্র প্রতিবাদকারী ছিলেন ফারাজ আইয়াজ হোসেন। হামলাকারীরা ফারাজকে বলেছিলেন, তুমি মুসলিম, তুমি চলে যাও। তিনি কিন্তু তাঁর বন্ধুদের মৃত্যুর মুখে রেখে একা চলে যেতে চাননি। ন্যায়-নীতি-মানবিকতার প্রতি তিনি ছিলেন অবিচল। জীবন দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন, শান্তি ও সৌভ্রাতৃত্বই আমাদের আদর্শ। তাঁর এই আত্মদান বৃথা যায়নি। সারা বিশ্বকে তিনি জানিয়ে দিয়ে গেছেন, শান্তি ও সহনশীলতার প্রয়োজনে এ দেশের মানুষ জীবনও দিতে পারেন।’

ফারাজের বড় ভাই যারেফ আয়াত হোসেন বলেন, ‘ফারাজের সাহসিকতা ছিল আলোকচ্ছটার মতো। সেই আলো আমাদের বেদনাময় দিনগুলো অতিক্রম করতে সহায়তা করেছে। দেশে-বিদেশে, চেনা-অচেনা অসংখ্য মানুষ ফারাজের প্রতি যে অকৃত্রিম ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেছে, তা আমাদের পরিবারকে শক্তি জুগিয়েছে।’

২০১৬ সালের ১ জুলাই হোলি আর্টিজান বেকারির জঙ্গি হামলায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল দেশের মানুষ। বহু বিদেশি ওই হামলার শিকার হওয়ায় তার অভিঘাত ছড়িয়ে যায় সারা বিশ্বে। এর মধ্যেও আলো হয়ে ফুটে উঠেছিল ফারাজ হোসেনের নাম। দিনে দিনে সেই আলো ছড়িয়ে পড়ছে দেশ থেকে দেশান্তরে।

সাহসী এই তরুণের নামে ‘ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন’ করেছে তাঁর পরিবার। তারা কাজ করছে আর্তদের সেবায়। তবে সবচেয়ে বড় আয়োজন করেছে পেপসিকো গ্লোবাল। ২০১৬ সালে তারা প্রবর্তন করে ‘ফারাজ হোসেন সাহসিকতা পুরস্কার’। আগামী ২০ বছর চলবে এ পুরস্কার। পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সনদের পাশাপাশি পাচ্ছেন ১০ হাজার মার্কিন ডলার।

চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে সিরাজুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজ চত্বরে ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট গড়ে তোলা হয়েছে ‘ফারাজ চত্বর’। সেখানে রোপণ করা হয়েছে নাগেশ্বর গাছের চারা।

বেসরকারি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয় ফারাজ আইয়াজ হোসেনের নামে শিক্ষাবৃত্তি চালু করেছে। একজন শিক্ষার্থী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে তাতে বিনা বেতনে পড়তে পারছেন। ফারাজ আইয়াজ হোসেন স্মরণে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে অনুষ্ঠিত হয় ‘পঞ্চম এনডিএফ বিডি-আরএমসি ডিসি জাতীয় মেডিকেল কলেজ বিতর্ক উৎসব’। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ে ‘ফারাজ চ্যালেঞ্জ কাপ’ নামে একটি ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করে শীর্ষ পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করা সাবেক কৃতী ফুটবলারদের সংগঠন সোনালী অতীত ক্লাব।

ওষুধ উৎপাদনকারী কোম্পানি এসকেএফ টঙ্গীর চেরাগ আলীতে তাদের নতুন কারখানা ভবনের নাম দিয়েছে ‘ফারাজ আইয়াজ হোসেন ভবন’।

অনন্য বন্ধুত্বের স্বীকৃতি হিসেবে ফারাজ হোসেনকে ভূষিত করা হয়েছে মাদার তেরেসা পুরস্কারে। ভারতের মুম্বাইয়ে পুরস্কারটি নিয়েছেন ফারাজের মা সিমিন হোসেন ও ভাই যারেফ আয়াত হোসেন।

ফারাজ হোসেনকে ২০১৮ সালের সমাবর্তনে গ্র্যাজুয়েট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের গয়জুয়েতা স্কুল অব বিজনেস। মৃত্যুবরণ করার সময় ফারাজের গ্র্যাজুয়েট শিক্ষাবর্ষ শেষ হওয়ার দুই বছর বাকি ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তন করেছে ‘ফারাজ হোসেন কোর ভ্যালু অ্যাওয়ার্ড’। ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয় ফারাজ হোসেন ও অবিন্তা কবিরের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁদের অক্সফোর্ড কলেজ ক্যাম্পাসে স্থাপন করেছে ‘হোসেন-কবির রুম’। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় মানবিকতার অনন্য নিদর্শন স্থাপনের জন্য ফারাজ হোসেনকে পুরস্কৃত করেছে।

সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, মানবতার কল্যাণে অবদান রাখা মানুষের স্মৃতি রক্ষায় বৃক্ষরোপণ ও স্মৃতিফলক স্থাপন করে থাকে গার্ডেন অব দ্য রাইচাস ওয়ার্ল্ডওয়াইড বা গারিও। এই উদ্যোগে জড়িত ইতালির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ইতালির মিলানভিত্তিক অলাভজনক এ সংগঠন ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই পাঁচজন ন্যায়নিষ্ঠ আরব ও মুসলিম ব্যক্তির স্মৃতির উদ্দেশে তিউনিসিয়ায় ইতালির দূতাবাসে ‘স্মৃতি-উদ্যান’টি স্থাপন করে। সেখানে ফারাজের নামে স্মৃতিফলক স্থাপন ও একটি বৃক্ষ রোপণ করা হয়। সেখানে ফারাজ হোসেনই একমাত্র অ-আরবীয়, যিনি এই বিরল সম্মান পেয়েছেন। ইতালির বেনেভোন্তো প্রদেশের রুমো হাইস্কুলে একটি গাছ লাগানো হয় ফারাজের স্মরণে।

দেশের আনাচকানাচে নানা সংগঠন ও পাঠাগার তাঁকে নিয়ে সভা-সেমিনার করেছে, নানাভাবে স্মরণ করেছে। ভারতের শিলিগুড়িতেও ফারাজের নামে ফুটবল টুর্নামেন্ট হয়েছে। জাগো ফাউন্ডেশনের সঙ্গে মিলে শিশু শিক্ষা কার্যক্রমসহ নানা ধরনের সহায়তার কাজ করছে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন।

সাভারে পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন কেন্দ্র সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজডে (সিআরপি) চালু হয়েছে ‘ফারাজ হোসেন সেন্টার’। এই সেন্টার বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের থেরাপি এবং বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানে ফিজিও, স্পিচ ও অকুপেশনাল থেরাপি দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতিদিন শতাধিক শিশু এই সুবিধা নিয়ে বেড়ে উঠছে। সেন্টারটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস লাইফবিষয়ক ডিন জোসেফ মুন, ধর্মশাস্ত্রের অধ্যাপক ডগলাস এ হিকস এবং উন্নয়ন ও অ্যালামনাই সম্পর্কবিষয়ক সহকারী ডিন কেভিন স্মিরল।

ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন কাজ করছে আর্তমানবতার সেবায়। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে আসা ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গাকে সব ধরনের সহায়তা দিয়েছে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। শীতে উত্তরাঞ্চলের মানুষ পেয়ে থাকে শীতবস্ত্র। ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন নিয়মিত চিকিৎসা ক্যাম্পের আয়োজন করছে। এ তালিকায় আছে চক্ষুশিবিরও। এ পর্যন্ত ১০ হাজারের বেশি মানুষকে চক্ষু চিকিৎসা দিয়েছে ফারাজ হোসেন ফাউন্ডেশন। এর মধ্যে পাঁচ শতাধিক মানুষের চোখে অস্ত্রোপচার করে চশমা দেওয়া হয়েছে। ফারাজের চোখের আলো এখন তাদের চোখে।

ফারাজের বড় ভাই যারেফ আয়াত হোসেন বললেন, ‘মা স্বপ্ন দেখতেন, ফারাজ অনেক বড় হবে। তবে ফারাজ যে এত বড় হয়ে এভাবে বিশ্বে বরণীয় হয়ে উঠবে, তা হয়তো তিনি কল্পনাও করেননি।’