সব বাহিনীর ব্যর্থতায় জঙ্গি হামলা

আইএস–সমর্থিত জঙ্গিগোষ্ঠী ‘নব্য জেএমবি’ হামলা চালিয়ে হইচই ফেলে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে শুরু করে হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার বছরখানেক আগে থেকে। প্রস্তুতি হিসেবে শুধু ঢাকাতেই তারা ছয়টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলে, এক বছরে ১৪টি হত্যাকাণ্ড চালায়, ভারতে জেএমবির পুরোনো সূত্রগুলোকে কাজে লাগিয়ে অস্ত্র আমদানি করে। কিন্তু হোলি আর্টিজানে হামলার আগ পর্যন্ত জঙ্গিদের গতিবিধিই কেউ শনাক্ত করতে পারেনি। অভিযোগ উঠেছে, পর্যাপ্ত গোয়েন্দা তথ্য না থাকা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথেষ্ট তৎপরতা না থাকায় এসব হামলা এড়ানো সম্ভব হয়নি।

গোয়েন্দা ব্যর্থতার এসব অভিযোগ সত্য কি না, জানতে চাইলে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, এটাকে ঠিক গোয়েন্দা ব্যর্থতা বলা যাবে না। ঢাকার কূটনৈতিকপাড়ায় হামলা হতে পারে—এমন ভাসা ভাসা একটা তথ্য ছিল, ওই এলাকায় নিরাপত্তাও জোরদার করা হয়েছিল। কিন্তু হামলার ব্যাপকতা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য তখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

গুলশানের হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার আট আসামির ছয়জন ঢাকার মুখ্য মহাগর হাকিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁরা জানান, ২০০৭ সালে জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অল্প কিছুদিন পরই দিনাজপুরের হিলিতে জেএমবির সদস্যরা এক হয়ে সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারাগারের ভেতরে ও বাইরে দুই জায়গাতেই তারা সক্রিয় হয়, তারা কর্মীদের নিয়োগ দেয়, বোমা বানানো শেখায়, অন্তর্দ্বন্দ্ব ও খুনোখুনির পরও সাংগঠনিক কাজ চালাতে থাকে।

২০১৪ সালের ২৯ জুন আবু বকর আল বাগদাদি ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়ার কার্যক্রম শুরু করলে জেএমবির একটি অংশ আইএসের মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরী এবং অপেক্ষাকৃত তরুণ ও শহুরে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা এই অংশে যোগ দেন। তাঁরা ‘জিহাদ’–এর উদ্দেশ্যে ঘর ছাড়ে, ভিন্নধর্মাবলম্বী, শিক্ষক, চিকিৎসক, পীরের খাদেম, পুরোহিতদের হত্যা করেন।

হোলি আর্টিজান হত্যা মামলায় দেওয়া আসামিদের জবানবন্দি পর্যালোচনায় দেখা যায়, পুরোনো জেএমবির কার্যক্রম কিংবা নব্য জেএমবিতে নিখোঁজ তরুণদের যোগদান, পুরোনো–নতুন জঙ্গিদের হত্যা–হামলার বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো নজর ছিল না।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি থাকলে হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা হতো না। অভিজ্ঞতা যেটা হয়েছে, সেটা হামলার পর। আত্মঘাতী জঙ্গি হামলা সম্পর্কে ধারণা থাকলে হোলি আর্টিজানে হামলা শুরুর পর পুলিশ কর্মকর্তারা ওভাবে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতেন না।

হোলি আর্টিজানে হামলার পর গ্রেপ্তার হওয়া রাকিবুল ইসলাম রিগ্যান ১৬৪ ধারায় আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ছয়টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কথা জানান। বগুড়া থেকে ঢাকায় এসে রাকিবুল অন্যদের সঙ্গে প্রথমে মিরপুরে পাঁচতলা ভবনের একটি কক্ষে ওঠেন। এরপর মিরপুর ১ নম্বরে মাজার মসজিদের তৃতীয় তলার একটি ফ্ল্যাট, মণিপুরে কাশেমের দোকানের পাশের ছয়তলা বাসার পঞ্চম তলার ফ্ল্যাট, পাইকপাড়ার বউবাজার, পাইকপাড়ার নতুন বাজার ও কল্যাণপুরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু হয়। পাইকপাড়া বউবাজারের চারতলা বাসায় হোলি আর্টিজান বেকারির পাঁচ হামলাকারীসহ সাতজন প্রশিক্ষণ নেন। ওটি ছিল প্রশিক্ষণার্থীদের দ্বিতীয় ব্যাচ। রাকিবুল প্রশিক্ষণার্থীদের ইস্তেহাদি বা আত্মঘাতী হামলায় উদ্বুদ্ধ করতেন। এ ছাড়া শারীরিক কসরত, অস্ত্র খোলা ও লাগানোর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল এই কেন্দ্রগুলোয়। বিভিন্ন সময় এই কেন্দ্রগুলোয় হোলি আর্টিজানে হামলার সমন্বয়ক তামিম আহমেদ চৌধুরী, মারজান, মেজর জাহিদ, বাশারুজ্জামান চকলেট খোঁজখবর করতেন ও টাকা দিয়ে আসতেন।

>

হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ৩ বছর
হামলার আগ পর্যন্ত জঙ্গিদের গতিবিধি কেউ শনাক্ত করতে পারেনি
অভিযোগ উঠেছে, পর্যাপ্ত গোয়েন্দা তথ্য ছিল না
জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের তৎপরতা কখনো বন্ধ হয়নি

কেন্দ্রগুলোয় তরুণদের পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করতেন আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে র‍্যাশ। ঢাকা মহানগর হাকিম সাদবীর ইয়াছিন আহসান চৌধুরীকে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আসলাম হোসেন বলেন, ‘জিহাদ’–এর উদ্দেশ্যে যেসব তরুণ ঘর ছাড়তে চাইতেন, তাঁরা সিক্রেট অ্যাপে তামিম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। একটি নির্দিষ্ট জায়গা থেকে তাঁদের তুলে নিয়ে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পৌঁছে দিতেন আসলাম। হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় জড়িত ঢাকার তিন তরুণ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রোহান ইমতিয়াজকে ২০১৫ সালের ২৫ বা ২৬ ডিসেম্বর লালমাটিয়ার আড়ংয়ের সামনে থেকে, পরের বছর ২৬ ফেব্রুয়ারি নিবরাস ইসলামকে ধানমন্ডির শুক্রাবাদের ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির কাছে পদচারী–সেতুর নিচ থেকে ও এর দুই দিন পর ২৮ ফেব্রুয়ারি ধানমন্ডি লেকের ধার থেকে মীর সামেহ মোবাশ্বেরকে তুলে তিনি মিরপুর ১০–এর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পৌঁছে দেন।

গুলশানে ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে পৌনে নয়টায় হোলি আর্টিজান বেকারিতে কয়েকজন যুবক অতর্কিত হামলা চালান। সেখানে পুলিশ গেলে তাদের সঙ্গে গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটে। ফাইল ছবি
গুলশানে ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে পৌনে নয়টায় হোলি আর্টিজান বেকারিতে কয়েকজন যুবক অতর্কিত হামলা চালান। সেখানে পুলিশ গেলে তাদের সঙ্গে গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটে। ফাইল ছবি

আসলামের কল্যাণপুরের মেস ও বাসা এবং তানভীর কাদেরির বসুন্ধরার বাসা জঙ্গিদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আসলাম, রাকিবুল ইসলাম ওরফে রিগ্যান ও জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী জানান, হোলি আর্টিজানে হামলার কয়েক দিন আগে আসলাম ও রাজীব গান্ধী গুলশান পার্ক ও হোলি আর্টিজান বেকারি রেকি করেন। ২০১৬ সালের মে মাসে তিনি রোহান ইমতিয়াজ ও নিবরাস ইসলামকে গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটানো হাতে–কলমে দেখাতে বুড়িগঙ্গা নদীতে যান এবং গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নির্বিঘ্নে আস্তানায় ফেরেন। কোথাও কখনো তাঁকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখোমুখি হতে হয়নি।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী নিজেকে নব্য জেএমবির উত্তরবঙ্গের সামরিক প্রধান হিসেবে উল্লেখ করেন। হোলি বেকারিতে হামলার আগে তিনি ১৩টি হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেন।

দক্ষিণাঞ্চলের পাঁচটি জেলায় হোলি বেকারিতে হামলার আগে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির কথা জানান হাদিসুর রহমান ওরফে সাগর। জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি বা মার্চের দিকে তাঁদের সংগঠনের কিছু ছেলে ঝিনাইদহ শহরের হামদ বাসস্ট্যান্ডের পাশে সোনালী মোড় এলাকায় অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য কাওসার আলীর বাসা ভাড়া নিয়ে মেস করে থাকতেন। ওই মেসে বসেই তাঁর সঙ্গে নিবরাস, মোবাশ্বের ও শরীফুল ইসলাম পায়েলের কথা হয়। তাঁরা জানান, ঢাকার কূটনৈতিকপাড়ায় বড় ধরনের হামলা হবে।

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আবদুস সবুর খান ওরফে সোহেল মাহফুজ বলেন, হোলি আর্টিজান বেকারিতে তাঁর সরবরাহ করা অস্ত্র ও গ্রেনেড ব্যবহৃত হয়। ২০১৬ সালে রমজানের প্রথম দিকে মিরপুর ১০ নম্বরে তামিম চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হয়। তাঁর নির্দেশে অ্যাপস ও মোবাইলে যোগাযোগ করে রমজানের ২০–২২ তারিখ ভারতে থাকা পুরোনো সদস্যদের মাধ্যমে অস্ত্র–গুলি ও গ্রেনেড সংগ্রহ করে সোহেল মাহফুজ ছোট মিজানকে দেন।

আসামিদের জবানবন্দিতে ঢাকার তুরাগ, আশুলিয়া, টঙ্গী, গাজীপুরের বোর্ডবাজার, বগুড়ার একাধিক স্থানে জঙ্গি তৎপরতার কথা আছে। চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনযোগে অস্ত্র আনার কথা রয়েছে। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ২০১৪ সালে ডা. নজরুল ইসলাম ও দুই বছর পর ফজলে রাব্বী খুনেরও কথা রয়েছে। হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পর জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানে কমপক্ষে ৮০ জন নিহত হন, যাঁদের অনেকেই ছিলেন নিখোঁজ হয়ে যাওয়া তরুণ।

যোগাযোগ করা হলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মতে, গোয়েন্দারা ব্যর্থ হয়েছেন। আমি বলব ভবিষ্যতের প্রস্তুতি হিসেবে গোয়েন্দা তৎপরতা জোরদার করতে হবে, কেউ নিখোঁজ রয়েছে, এমন তথ্য গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। ’