খুলনায় বন্ধ হয়ে গেল ঐতিহ্যবাহী ইন্দ্রমোহন সুইটস

১৩০ বছরের ঐতিহ্যবাহী ইন্দ্রমোহন সুইটস গত রোববার থেকে বন্ধ হয়ে গেছে। ইন্দ্রমোহন সুইটসের এই ভবন ভেঙে ফেলা হচ্ছে। গতকাল বিকেলে তোলা।  প্রথম আলো
১৩০ বছরের ঐতিহ্যবাহী ইন্দ্রমোহন সুইটস গত রোববার থেকে বন্ধ হয়ে গেছে। ইন্দ্রমোহন সুইটসের এই ভবন ভেঙে ফেলা হচ্ছে। গতকাল বিকেলে তোলা। প্রথম আলো

বন্ধ হয়ে গেছে ১৩০ বছরের পুরোনো খুলনার ঐতিহ্যবাহী ইন্দ্রমোহন সুইটস। প্রতিষ্ঠানটির পুরোনো ভবনটি ভেঙে সেখানে নতুন ভবন নির্মাণ করবে মালিকপক্ষ। এ জন্য গত রোববার পুরোনো ঠিকানা গুটিয়ে নিয়েছেন ইন্দ্রমোহনের বংশধররা।

এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ওই মিষ্টির দোকানের যখন গোড়াপত্তন হয়েছিল, দেশ তখন ব্রিটিশদের অধীনে। ১৮৯০ সালের কিছু আগে বা পরে ইন্দ্রমোহন দে ব্যবসাটি শুরু করেন। হেলাতলা রোডের ওই বাড়ির একটি অংশ ভাড়া নিয়েই শুরু করেন ব্যবসা। ইন্দ্রমোহনে মিলত পাঁচ পদের সুস্বাদু মিষ্টি। রসগোল্লা, পানতুয়া, সন্দেশ, চমচম ও দানাদার। এই দোকানে শুরু থেকে কিছু প্রথা চালু ছিল। সেখানে গরম, সুস্বাদু ও নির্ভেজাল মিষ্টি পাওয়া গেলেও খেতে হতো হাত দিয়েই। চাইলেও মিলত না চামচ। পরিবেশনেও ছিল ভিন্নতা। স্টিলের প্লেটের ওপর কলাপাতা বিছিয়ে দেওয়া হতো মিষ্টি। আর সন্দেশ শুধু কলাপাতায়। কেজিতে নয়, মিষ্টি বিক্রি হতো সংখ্যা হিসেবে। প্রতিদিন যে মিষ্টি তৈরি হতো, ওই দিনই তা শেষ হয়ে যেত। বাসি মিষ্টির কোনো কারবার সেখানে ছিল না।

ব্রিটিশ আমল থেকে উপমহাদেশের অনেক নামী ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতিবিদ এই দোকানের মিষ্টির স্বাদ নিয়েছেন। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার খুলনা সফরে এসেও ইন্দ্রমোহন সুইটসে যান।

গতকাল সোমবার বিকেলে হেলাতলা রোডের ১০ নম্বর বাড়ির নিচতলায় থাকা ওই দোকানে গিয়ে দেখা গেল, পুরোনোর বাড়িটার সরু সদর দরজার ওপর ছোট চারকোনা নীল রঙের টিনের পাতের ওপর সাদা কালিতে ইন্দ্রমোহন সুইটস লেখাটা এখনো আছে। তবে ছোট্ট দরজার কপাট আর নেই। জানালাগুলোতে নেই কোনো কপাট। দেয়ালে এখনো সাঁটানো কিছু দিনপঞ্জি আর ছবি। দোকানের মধ্যে রাখা আছে কয়েকটা সাইকেল। আশপাশের দুজন পান বিক্রেতা সেখানে মেঝেতে পাটি পেতে দুপুরের খাবার সারছেন। আশপাশের দোকানিদের কাছে ইন্দ্রমোহন কবে বন্ধ হলো, আশপাশে আবার দোকানটা গেছে কি না, এসব প্রশ্ন করছেন নানাজন।

দোকানের পাশে একটি খুঁটিতে বিশেষ বিজ্ঞপ্তি লেখা একটা প্যানা ঝোলানো। ওই বিজ্ঞপ্তির ভাষ্য হচ্ছে, দোকানঘরের জায়গার ওপর বহুতল বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের লক্ষ্যে পুরোনো ভবন ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ করবেন মালিক সেলিনা হক। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আদেশমতে ভবন নির্মাণের পর তাঁদের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে নিচতলায় দোকানঘর বরাদ্দ প্রদানের আদেশ আছে। সে জন্য ৩০ জুন খালি অবস্থায় মালিককে দখল বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁরা।

গতকাল বিকেলেও মিষ্টির স্বাদ নিতে সেখানে অনেককে আসতে দেখা যায়, যাঁরা জানতেন না ইন্দ্রমোহন বন্ধ হয়ে গেছে। সে রকমই একজন খুলনা বিটিসিএলের উপমহাব্যবস্থাপক (অর্থ ও রাজস্ব) সৈয়দ আবুল কালাম। নগরের টুটপাড়া এলাকার ওই বাসিন্দা বলেন, ‘যখনই বাজারে আসি, তখনই এখানে একবার ঢুঁ দিতে যাই। এখানকার মিষ্টি একবার যিনি খেয়েছেন, তাঁর পক্ষে স্বাদ ভোলা কঠিন। বিশেষভাবে তৈরি পানতুয়া অনেক নরম। সুস্বাদু এ পানতুয়া মুখে দিলেই গলে যাবে। অভ্যাসবশত আজও এলাম কিন্তু দেখছি দোকান তো বন্ধ হয়ে গেছে। আধুনিকতার কাছে ঐতিহ্য আসলে টিকছে না।’

খুলনার দৌলতপুরের বাসিন্দা সমৃদ্ধি স্বস্তি বলছিলেন, ‘এই মিষ্টির সঙ্গে এই শহর ও অঞ্চলের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের সম্পর্ক রয়েছে। উন্নয়নের নামে আমাদের অনেক কিছুই আর আমাদের থাকবে না। অনেক কিছুই হারিয়ে যাবে উন্নয়নের ইট-পাথরের নিচে।’

ইন্দ্রমোহনের ছেলে-নাতি প্রতিষ্ঠার সময়কার ঐতিহ্য ধরে ব্যবসা করছিলেন। ইন্দ্রমোহনের ছেলে বেনীমাধব দে জানান, প্রথমে গোলের ঘর, এরপর টিনের ঘর এবং সব শেষে দোতলা দালানে তাঁরা ১৩০ বছর ধরে ব্যবসা করছেন। এরপর ছয় মালিক বদল হয়েছে। বর্তমান বাড়িওয়ালা তাঁদের এখান থেকে উচ্ছেদ করতে মামলা করেছিলেন। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠান ছেড়ে যেতে চাননি তাঁরা। তাই মামলা লড়েছেন। ১৮ বছর মামলা লড়ে অবশেষে হেরে যেতে হলো। আদালতের আদেশেই গত রোববার তাঁরা ভবন খালি করে দিয়েছেন।

ইন্দ্রমোহন সুইটসের কর্মচারী কমল চন্দ্র সরকার জানান, তিনি ৪০ বছর ধরে এখানে কাজ করছেন। এখানকার বেশির ভাগ কর্মচারীই ৪০-৫০ বছর ধরে এখানে আছেন। সবাই প্রতিষ্ঠানকে নিজের মনে করেন। বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁরা অনেকটা দিশেহারা। তাঁরা চেষ্টা করছেন আশপাশে কোথাও একটা দোকান নিতে। আর মালিকপক্ষ নতুন ভবন নির্মাণ করে তাঁদের একটি দোকান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু কবে কাজ শেষ হবে আর দোকান পাওয়া যাবে, সবকিছু অনিশ্চিত।