মুন্সিগঞ্জে সাত কিলোমিটারের 'যন্ত্রণার যাত্রা'

মুন্সিগঞ্জ
মুন্সিগঞ্জ

সড়কপথে ঢাকা থেকে মুন্সিগঞ্জের দূরত্ব মাত্র ২৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটী পর্যন্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার তেমন কোনো ঝামেলা ছাড়াই পার হওয়া যায়। এরপরই শুরু হয় ‘যন্ত্রণার যাত্রা’। পঞ্চবটী থেকে মুন্সিগঞ্জের চর সৈয়দপুর (মুক্তারপুর সেতু) পর্যন্ত সাড়ে সাত কিলোমিটার অংশ যেতে দুর্ভোগ চরমে ওঠে। 

সরু এই সড়কের কোথাও ভাঙা, কোথাও গর্ত, কোথাও ইট বিছানো। এই পথটুকু পেরোতে কেটে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সেতুর পর বাকি সাড়ে তিন কিলোমিটার পথটুকু অবশ্য মসৃণ। 

মুন্সিগঞ্জ জেলা সদর এবং টঙ্গিবাড়ী উপজেলার বাসিন্দাদের সড়কপথে ঢাকায় আসার প্রধান পথ এটি। জেলার অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বাণিজ্যিক স্থাপনা সদরে। পদ্মা সেতু চালুর পর এই সড়কটি বিকল্প সড়ক হিসেবেও ব্যবহারের পরিকল্পনা আছে। 

মুন্সিগঞ্জ জেলা সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) এক কর্মকর্তা জানান, পাকিস্তান আমলে এই সড়কটির জন্য ৮০ থেকে ১২০ ফুট পর্যন্ত জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। দখল হতে হতে সড়কটির প্রশস্ততা কমে ২০ ফুটে এসে ঠেকেছে। জায়গা দখল করে একের পর এক গড়ে উঠেছে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। তৈরি পোশাক কারখানা, বিপণিবিতান, বাজার বানিয়ে ধীরে ধীরে সড়কের জায়গা দখল করা হয়েছে। 

সম্প্রতি এই সড়কে সরেজমিনে দেখা গেছে, সাড়ে সাত কিলোমিটারের মধ্যে প্রায় ৪০০ মিটার সড়কে ইট বিছানো। সেখানে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই জায়গায় জায়গায় পানি জমে যাচ্ছে। সড়কে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ও মালবাহী বড় ট্রাকের সংখ্যাই বেশি। কোনো পরিবহন বিকল হলে দীর্ঘ যানজট লেগে যায়। দীর্ঘদিন ধরে রক্ষণাবেক্ষণ না করায় আস্তে আস্তে সড়কের পাশে অসংখ্য দোকানপাট গড়ে উঠেছে। এসব দোকান ভেঙে সড়ক চওড়া করা ছাড়া উপায় নেই। 

ভোগান্তির শুরু চর সৈয়দপুর মোড় থেকে। গোগনগর, কাশিমপুর হাটখোলা, মধ্যপাড়া, উত্তর কাশিমপুর দেওয়ানবাড়ি, ভোলাইল, এনায়েতনগর এবং পঞ্চবটীর বিসিক এলাকায় তীব্র যানজটে পড়তে হচ্ছে। এসব এলাকায় মূল সড়ক ঘেঁষেই নির্মিত হয়েছে অসংখ্য দোকানপাট। গাড়ির চাপ বাড়লে হাঁটারও উপায় থাকে না। চর সৈয়দপুর ও বিসিক এলাকায় ইট বিছানো সড়কে ভোগান্তির মাত্রা কয়েক গুণ বেশি। 

ঢাকা থেকে মুন্সিগঞ্জ রুটে এখন দিঘীরপাড় নামে একটি কোম্পানির বাস চলাচল করে। এর ব্যবস্থাপক শামসুদ্দীন হালদার প্রথম আলোকে বলেন, চার বছর আগেও এ পথে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনসহ (বিআরটিসি) চারটি কোম্পানির বাস চলাচল করত। সে সময় তাঁদের কোম্পানির ৫৫টি বাস ছিল। সড়কের খারাপ অবস্থার কারণে যাত্রীরা বাসে চলাচল প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। অন্য তিনটি প্রতিষ্ঠানের বাস বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের কোম্পানির বাস ২৮টিতে নেমে এসেছে। 

একটি বাসের চালক আবদুর রহমান বলেন, এই সরু সড়কে বাস চালানো কঠিন। বিপরীত দিক থেকে একটি ছোট যানবাহন এলেই গতি কমাতে হয়। দুটি গাড়ি পাশাপাশি চলতে পারে না। বিকেলে পোশাক কারখানা বা অন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ছুটি হলে সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হয়। 

স্থানীয় সাংসদ (মুন্সিগঞ্জ-৩) মৃণাল কান্তি দাস প্রথম আলোকে বলেন, পঞ্চবটী থেকে চর সৈয়দপুর পর্যন্ত উড়ালসড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। উড়ালসড়কের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) বিশেষজ্ঞদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অবশ্য কবে নাগাদ এই পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখবে, এ বিষয়ে তিনি স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। 

স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক দশক ধরেই তাঁরা জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে এই সড়ক সংস্কারে অনেকবার আশ্বাস পেয়েছেন। তবে বাস্তবে কোনো কাজ হয়নি। 

মুক্তারপুর সেতুর ব্যবস্থাপক হারুন অর রশিদ বলেন, প্রতিদিন আট থেকে সাড়ে আট হাজার যানবাহন সেতু পার হয়ে ঢাকাসহ অন্য অঞ্চলগুলোকে যাতায়াত করে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন এই সংখ্যা দশ থেকে সাড়ে দশ হাজার পর্যন্ত হয়ে থাকে। 

সড়ক সংস্কারের বিষয়ে জানতে চাইলে (সদ্য বদলি হওয়া) জেলা প্রশাসক সায়লা ফারজানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছর জেলা প্রশাসক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর সামনে তিনি এই সড়কের বিড়ম্বনার বিষয়টি তুলে ধরেছিলেন। গত মাসে সেতু বিভাগ থেকে এই সড়ক সংস্কারের একটি ইতিবাচক খবর পেয়েছেন। তবে সড়কটি যত দিন না চওড়া করা হচ্ছে তত দিন পর্যন্ত মুন্সিগঞ্জবাসীর এই দুঃখ থাকবে।’ 

পরে সেতু বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুক্তারপুর সেতুর দক্ষিণ অংশ দিয়ে সদরের সিপাহিপাড়া, টঙ্গিবাড়ী ও লৌহজং উপজেলা হয়ে পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক রয়েছে। তাই মুক্তারপুর সেতুর উত্তর দিকে এই সাড়ে সাত কিলোমিটার সড়ক সংস্কারের বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এই সড়কটির দুই পাশের জায়গা সংকুলান করা সম্ভব হলে চার লেনে উন্নীত করা হবে। আর না হলে সড়কের ওপর দিয়ে দুই লেনের উড়ালসড়ক করা হবে।