দুষ্প্রাপ্য মাছ 'বাচা'

বাচা মাছ। ছবি: লেখক
বাচা মাছ। ছবি: লেখক

বর্তমানে বাংলাদেশে মহাসংকটাপন্ন এবং বিলুপ্তপ্রায় মাছ বাচা। আমাদের দেশে স্বাদু পানি বা মিঠাপানির মাছ রয়েছে প্রায় ২৯৬ প্রজাতির। শিং-মাগুর-কই, চেলা-ঢ্যালা-মলা, পুঁটি-খলিশা-টাকিসহ দেশীয় আনুমানিক ২৬০ প্রজাতির মাছ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জলাশয়গুলোতে এখনো বিচরণ করছে বা এগুলোর চাষাবাদ চলছে। দেশীয় এই প্রজাতিগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটি বিপন্ন অবস্থায়, কোনো কোনো প্রজাতি সংকটাপন্ন অবস্থায় আর কিছু প্রজাতি রয়েছে একেবারে মহাবিপন্ন অবস্থায়। বিগত ৩০–৪০ বছরের মধ্যে চন্দনবাউশ, নান্দিল, অ্যালং, বাইটক্যা ইত্যাদি অতি উৎকৃষ্ট স্বাদের মাছগুলো বাংলাদেশ থেকে প্রায় বিলুপ্তই হয়ে গেছে।

পরিচিতি
বাচা মিঠা পানির মাছ। এ মাছ সিপ্রিনিফরমিস বা সিলুরিফরমিস বর্গের অন্তর্ভুক্ত। একই বর্গের অন্যান্য মাছের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কাজলি, ঘাউরা, বাতাসি, শিলং ইত্যাদি।

বাচা মাছের মাথা এবং শরীর চাপা। থুতনির আগা ছুঁচালো। ওপরের চোয়াল সামান্য লম্বা, মুখের চিড় গভীর এবং চোখের নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত। দাঁত তীক্ষ্ণ এবং ধারালো। আঁশযুক্ত দাড়ি মোট ৪ জোড়া। দণ্ডযুক্ত পিঠের পাখনাটি ছোট। পিঠের কাটার পেছন দিকটি রাতের দাঁতের মতো। বুকের পাখনা শ্রেণি পাখনার কাছাকাছি। শ্রেণি পাখনা ছোট। লেজের পাখনা গভীরভাবে বিভক্ত। পিঠ ঈষৎ ধূসর হলেও মাছটির রং রুপালি। বুকের পাখনা ও লেজের পাখনার কিনারা কালো। মাছটি লম্বায় ১০ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে।

বাচা মাছের আবাস সাধারণত নদীতে। স্রোতময় নদীর পানিতে এরা ঝাঁক বেঁধে চলাফেরা করে। মাছটি ভ্রমণপ্রিয়। মাছটি নদী থেকে প্লাবনভূমি এবং প্লাবনভূমি থেকে নদীতে বেশি আনাগোনা করতে ভালোবাসে। পানির উপরিতলেই বেশি থাকে। এরা বর্ষাকালে নদীতে প্রজনন করে। রাত্রিকালে সাধারণত খাদ্য গ্রহণ বেশি করে থাকে। খাদ্যতালিকায় রয়েছে পতঙ্গ, ছোট মাছ, শামুক ও শেওলা। বাংলাদেশের নদ–নদীগুলোর মধ্যে পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্র নদে এই মাছটি বেশি দেখা যায়। কাপ্তাই হ্রদে একসময় প্রচুর পরিমাণে বাচা মাছ ছিল। বর্তমানে সেখানে প্রায় বিলুপ্তির পর্যায়ে।

আরেক জাতের বাচা রয়েছে যেটি স্থানীয়ভাবে ‘মুরি বাচা’ নামে পরিচিত। এটি অনেকটা খাটো আকারের হয়ে থাকে।

বাচা গোত্রের আর একটি মাছ ঘাউরা। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
বাচা গোত্রের আর একটি মাছ ঘাউরা। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস


পুষ্টিমান
বাচা মাছের পুষ্টিমান উল্লেখ করার মতো। ১০০ গ্রাম বাচা মাছে জলীয় অংশ রয়েছে ৬৮.৮ গ্রাম, আমিষের অংশ রয়েছে ১৮.১ গ্রাম, চর্বি রয়েছে ৫.৬ গ্রাম, শর্করা ৬.১ গ্রাম, খনিজ পদার্থের পরিমাণ ১.৪ গ্রাম, ক্যালসিয়াম রয়েছে ৫২০ মিলিগ্রাম, লৌহ ০.৭ মিলিগ্রাম, ক্যালরি বা খাদ্যশক্তি ১৪৭ মিলিগ্রাম এবং ভিটামিনের পরিমাণ ১৩.০ মিলিগ্রাম।

মৌসুম ও মোকাম
অভিজাত শ্রেণির মাছ বাচা। বর্ষাকাল হচ্ছে বাচা মাছের প্রধান মৌসুম। পুরো শীতকালেও পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা ও মেঘনা নদ–নদীর কাছের বাজারগুলোতে বাচা মাছের আমদানি হয়ে থাকে। বাচা মাছের বড় মোকামগুলোর মধ্যে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় রাজশাহী মহানগরীর সাহেববাজার, সিরাজগঞ্জ বাজার, ভৈরব বাজার, চাঁদপুর বাজার, অষ্টগ্রাম, কুলিয়ারচর, গোয়ালন্দ ঘাট, মাওয়া ঘাট ইত্যাদি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিশেষ করে ভৈরব বাজারের বিশাল মাছের আড়ত থেকে বাচা মাছের বড় চালান ঢাকার মাছের বাজারগুলোতে আসে।

অনেক দেশীয় মাছের মতো বাচা মাছও বিলুপ্তির পথে। ছবি: লেখক
অনেক দেশীয় মাছের মতো বাচা মাছও বিলুপ্তির পথে। ছবি: লেখক


বাচা গোত্রের অন্যান্য মাছ
বাচা কিংবা মুরি বাচা মাছের মতো আকৃতির আরেকটি মাছ রয়েছে, যার নাম শিলং। এর স্থানীয় নাম সিলোন্দা, ধাইন, ঢাইং, সিলোং ইত্যাদি। মাছটির বৈজ্ঞানিক নাম সিলোনিয়া সিলোডিয়া এবং ইংরেজি নাম সিলোনিয়া ভাচা। এ মাছটি আকারে অনেক বড় হয়। কোনো কোনো মাছ লম্বায় ১.৮০ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। শিলং মাছের ঠোঁট লাল হয়ে থাকে। গাত্র বর্ণ রুপালি। শিলং মাছের চোয়াল লম্বা।

বাচা, মুরি বাচা ও শিলং মাছের মতোই প্রায় দেখতে ঘাউরা মাছ (ক্লাপিজমা গারুয়া)। তবে বাচা, মুরি বাচা এবং শিলং মাছের মুখ লম্বাটে কিন্তু ঘাউরা মাছের মুখ অনেকটা চওড়া ও গোলাকার। অনেক সময় বাচা, শিলং ও ঘাউরা মাছের পার্থক্য করা কষ্টকর হয়ে ওঠে। ঘাউরা মাছের রং এবং আকৃতি বাচা মাছের মতোই। ঘাউরা মাছের পিঠে ডানা রয়েছে মাত্র একটি। বাচা ও শিলং মাছের দ্বিতীয় ডানাটি পুচ্ছ পাখনার প্রায় কাছাকাছি অবস্থানে দেখা যায়। ঘাউরা মাছের পিঠের একমাত্র ডানাটি মাথার প্রায় কাছাকাছি অবস্থানে দেখা যায়। ঘাউরার মুখ অনেকটা মোটা। বাচা, মুরি বাচা, শিলং ও ঘাউরা এই মাছগুলো কিন্তু প্রায় একই স্বাদের। চলনবিল অঞ্চলের গাঙ ঘাউরা স্বাদে অতুলনীয়। মাছগুলো কাটাবহুল নয় বলে খেতে বেশ নিরাপদ। তবে ঘাউরা মাছের খাদ্যতালিকায় নোংরা জাতীয় বস্তু থাকায় সাধারণভাবে এর কদর খুব একটা নেই।

বাচা গোত্রের শিলং মাছ। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস
বাচা গোত্রের শিলং মাছ। ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস


বাচা মাছের জীবনযাত্রা
প্রখ্যাত মৎস্য বিজ্ঞানী এফ হ্যামিলটন (১৮২২) রচিত ‘অন অ্যাকাউন্ট অব দ্য ফিশেস ফাউন্ড অন দ্য রিভার গ্যাঞ্জেজ অ্যান্ড ইটস ব্র্যান্সেস’ নামক আকর গ্রন্থে বাচা এবং মুরি বাচা মাছ নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করেছেন। বাচা মাছ বাংলাদেশের প্রায় সব নদীগুলোতে দেখা গেলেও মূলত এটি পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা ও যমুনা নদ–নদীতে বেশি দেখা যায়। যমুনা ও পদ্মা নদীতে বর্ষার শুরুতে নতুন পানিতে মা মাছ ডিম দেয়। আবার অনেক সময় মা মাছ ডিম দেওয়ার জন্য চলনবিলসহ বাংলাদেশের হাওর, বাঁওড় এবং উল্লিখিত নদীগুলোর কাছাকাছি যে বিলগুলো রয়েছে, সেগুলোতে চলে যায়। একটা সময় ছিল যখন বড়াল এবং হুড়াসাগর নদীর নাব্যতা ছিল। সে সময় বাচা মাছসহ শত শত প্রজাতির মিঠা পানির মা মাছ কিংবা রেণু মাছ বড়াল, আত্রাই, নারদ, হুড়াসাগর ইত্যাদি নদীর মাধ্যমে চলনবিলে প্রবেশ করত। চলনবিলে রয়েছে এ জাতীয় মাছের বিশাল খাদ্যের ভান্ডার। সেখানে মাছগুলো বৃদ্ধি পেত। বর্ষার শেষে মাছগুলো মূল নদীতে ফিরে যেত। বর্ষাকালে কিংবা বর্ষার শেষে বিশাল চলনবিল অঞ্চলে অবস্থিত আত্রাই, নলডাঙ্গা, সিংড়া, গুরুদাসপুর, তাড়াশ, চাটমোহর, উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর, ভাঙ্গুরা, ফরিদপুর এবং সাঁথিয়া থানার হাটবাজারে বাচা মাছের আমদানি ছিল দেখার মতো। ইদানীং তেমনটা আর নেই। হুড়াসাগর সেই কোন কালে ভরাট হয়ে গেছে। বড়ালে ভরা বর্ষাতেও পদ্মা থেকে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে পানির প্রবাহ দেখা করা যায় না। যমুনা থেকে মে–জুন মাসে পানি বাঘাবাড়ী হয়ে চলনবিলে প্রবেশ করে। প্রায় একই সময়ে আত্রাই নদে দিয়ে পানি চলন বিলে আসতে থাকে। বড়াল হয়ে নন্দকুজার মাধ্যমে পদ্মার পানি চলনবিলে প্রবেশ করতে শুরু করে জুলাই মাস থেকে। এ সময় বাচা মাছ ঝাঁকে ঝাঁকে পানিতে খেলে বেড়ায়। এরা নদী থেকে প্লাবনভূমি এবং প্লাবনভূমি থেকে নদীতে ভ্রমণ করে। বিশাল চলনবিল এবং এর পাশের জনপদগুলোর বিরাট একটি অংশ হচ্ছে পদ্মা, যমুনা ও আত্রাই নদের প্লাবনভূমি। বিগত দেড় যুগ থেকে নদীতে পানিই নেই, তাই প্লাবনও নেই। নদী ভরাট হয়ে যাওয়া, অতিরিক্ত মাত্রায় ফসলের খেতে কীটনাশক প্রয়োগ ইত্যাদি কারণে মাছের আবাস নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে অনেক দেশীয় মাছের মতো বাচা মাছও বিলুপ্তির পথে।

বাচা মাছের মতো বিলুপ্তপ্রায় অতুলনীয় স্বাদের মাছের প্রজাতি রক্ষার জন্য আমাদের সবাইকে হতে হবে সচেতন। শুধু নির্দিষ্ট বিভাগের লোকজনের ওপর এর দায়-দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে দেশের সচেতন নাগরিকদের দায়িত্ব শেষ হয়েছে বলে আমরা ভাবতে পারি না। এই দুর্লভ এবং দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির মাছগুলো আমাদের অমূল্য সম্পদ এবং ঐতিহ্য। আমাদের অবহেলার কারণে বেশ কিছু স্বাদু পানির মাছকে আমরা চিরদিনের জন্য হারিয়েছি। আমাদের নতুন প্রজন্মকে শুধু গল্পের মাধ্যমে বিলুপ্ত মাছের কথা জানাচ্ছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা আর বিলুপ্ত মাছের কাহিনি শোনাতে চাই না।