আলোচনা-ভাবনায় আবারও আড়িয়াল বিল

আড়িয়াল বিল। গত বছরের ছবি। ছবি: সুহাদা আফরিন
আড়িয়াল বিল। গত বছরের ছবি। ছবি: সুহাদা আফরিন

প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণে আবারও আলোচনায় এসেছে মুন্সিগঞ্জের আড়িয়াল বিল এলাকার নাম। এই এলাকায় বিমানবন্দরটির নির্মাণকাজ সরকারের উচ্চ মহলেরও ইচ্ছে রয়েছে। বলা হচ্ছে, যাঁরা আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণে বিরোধিতা করে আন্দোলন করেছিলেন, তাঁরাও আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের দাবি জানাচ্ছেন। তবে স্থানীয় সাংসদসহ আড়িয়াল বিল এলাকার জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

২০১০ সালে মুন্সিগঞ্জ জেলার আড়িয়াল বিল এলাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু পরের বছর জমি অধিগ্রহণের কার্যক্রম শুরু হলে আন্দোলন শুরু করে আড়িয়াল বিল এলাকার মানুষ। এই আন্দোলনের মুখে সেখানে বিমানবন্দরের নির্মাণ প্রকল্পটি স্থগিত করা হয়।

বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিষয়ে জানতে চাইলে গত মঙ্গলবার ২ জুলাই বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন সচিব মো. মহিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, আড়িয়াল বিলের বিমানবন্দরের বিপক্ষে যাঁরা ছিলেন, তাঁরাই সেখানে বিমানবন্দর চাইছেন। এ নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলা হবে। তা ছাড়া যেসব এলাকা বিমানবন্দরের জন্য বিবেচনা করা হচ্ছে, সেসব এলাকার সাংসদদের উপস্থিতিতে একটি প্রেজেন্টেশন থাকবে। সেখানে বিমান প্রতিমন্ত্রী থাকবেন। তাঁদের মতামতের ভিত্তিতে প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করা হবে।

সিদ্ধান্ত বদলের কারণ জানতে কথা হয় আড়িয়াল বিল রক্ষা কমিটির কার্যকরী পরিষদের সদস্য বরাইখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান মো. ইকবাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য আমরা জুন মাসে ঢাকায় শিক্ষা ভবন মিলনায়তনে বৈঠক করি। আমাদের পরবর্তী বৈঠক ৬ জুলাই শ্রীনগর উপজেলা পরিষদে অনুষ্ঠিত হবে।’

আড়িয়াল বিল। গত বছরের ছবি। ছবি: সুহাদা আফরিন
আড়িয়াল বিল। গত বছরের ছবি। ছবি: সুহাদা আফরিন

ইকবাল হোসেন বলেন, ‘আমাদের জমি এমনিই তো ডেভেলপার কোম্পানি কিনে নিত। তার চেয়ে আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর অনেক ভালো। আগে আন্দোলনের সময় আমাদের বলা হয়, ভূমিদস্যুরা জমি দখল করবে। এলাকার স্কুল-কলেজ, ঘরবাড়ি কিছু থাকবে না। তা ছাড়া বিমানবন্দর হবে ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার একর এলাকাজুড়ে।

এদিকে প্রায় চার বছর বন্ধ থাকার পর ২০১৫ সালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর প্রকল্পের কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়। ওই বছরের জানুয়ারি থেকে বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় নতুন করে বঙ্গবন্ধু বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য জায়গা চিহ্নিত করার কাজ শুরু করে। প্রকল্পটির জন্য মাদারীপুরের শিবচরের চর জানাজাত, ঢাকার দোহারের চর বিলাসপুর, মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানের কেয়াইন ও লতব্দি এলাকাকে প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হয়। পরের বছর ২০১৬ সালের ২১ সেপ্টেম্বর নতুন করে বিস্তারিত সম্ভাব্যতা সমীক্ষার জন্য বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সঙ্গে এক চুক্তির মাধ্যমে জাপানি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিপ্পন কোয়ি লিমিডেটকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি নতুন বিমানবন্দরের জন্য ১৮ মাসের মধ্যে সম্ভাব্যতা যাচাই, স্থান নির্ধারণ ও বিমানবন্দরের মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ করবে বলে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে জানানো হয়।

বেবিচক সূত্রে জানা গেছে, নিপ্পন কোয়ি লিমিটেড প্রাথমিকভাবে মাদারীপুর জেলার শিবচর ও শরীয়তপুর জেলার জাজিরায় নতুন বিমানবন্দরের জন্য সম্ভাব্য উপযুক্ত স্থান হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। কিন্তু দুটি এলাকা ঘন জনবসতিপূর্ণ। এ ছাড়া এসব এলাকায় খাসজমি বেশ কম। তাই জাজিরা ও শিবচর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য অনুপযোগী। এ কারণে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি নিপ্পন কোয়ি লিমিটেডকে বিমানবন্দর নির্মাণের স্থান হিসেবে কম ঘনবসতিপূর্ণ ও খাসজমি বেশি রয়েছে এমন এলাকা বেছে নিতে বলে বেবিচক।

বেবিচকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, চলতি জুলাই মাসে বেবিচকের কাছে নতুন বিমানবন্দরের সম্ভাব্য এলাকার বিষয়ে উপস্থাপনা তুলে ধরবে নিপ্পন কোয়ি লিমিটেড। সম্ভাব্য স্থানগুলোর ভালো–মন্দ সব বিষয় সম্পর্কে এই উপস্থাপনায় ধারণা পাওয়া যাবে।

বেবিচকের সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান নাইম হাসান প্রথম আলোকে বলেন, সম্ভাব্য সব এলাকা নিয়ে প্রেজেন্টেশন (উপস্থাপনা) দেবে জাপানিরা। আড়িয়াল বিলও এর মধ্যে রয়েছে। বিমানবন্দর আগের মতো এলাকা নিয়েই নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। লম্বায় ৮ কিলোমিটার ও প্রস্থে ৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিমানবন্দরটি নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।

আড়িয়াল বিল। গত বছরের ছবি। ছবি: সুহাদা আফরিন
আড়িয়াল বিল। গত বছরের ছবি। ছবি: সুহাদা আফরিন

বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের ব্যাপারে ২০১০ সালের ২৯ আগস্ট অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। ওই বৈঠকে প্রকল্পটি সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তখন প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। ২০১০ সালে নতুন বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য প্রাক্‌-সম্ভাব্যতা যাচাই কমিটি সাতটি স্থান সরেজমিনে পরিদর্শন করে তিনটি স্থানের নাম প্রস্তাব করে। এর মধ্যে একটি স্থান ছিল ময়মনসিংহের ত্রিশাল। অন্যটি টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর। পরে ওই তিনটি স্থান থেকে সরে আসে সরকার। এরপর এ-সংক্রান্ত কমিটির সুপারিশে ২০১০ সালের নভেম্বরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য মুন্সিগঞ্জের আড়িয়াল বিলকে চূড়ান্তভাবে বেছে নেওয়া হয়।

কিন্তু আড়িয়াল বিলে জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হলে এলাকাবাসী বিরোধিতা করেন। ২০১১ সালের শুরুতেই বিমানবন্দরের বিরোধিতা করে ‘আড়িয়াল বিল রক্ষা কমিটি’র ব্যানারে আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনকারীরা বলেন, আড়িয়াল বিলের প্রতি একর জমিতে ১০০ মণ ধান হয়। শুষ্ক মৌসুমে হয় রবিশস্য। বর্ষায় মাছ চাষ ছাড়াও লাখ লাখ টাকার শামুক হয়। এ শামুক বিক্রি করেও অনেকের জীবিকা চলে। বিমানবন্দর নির্মাণ করা হলে আড়িয়াল বিল এলাকার লোকজন এসব কিছুই হারাবেন। জীবিকা নির্বাহের আর কোনো পথ থাকবে না।

ওই বছর ৩১ জানুয়ারি গ্রামবাসী ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে একজন পুলিশ সদস্য নিহত হন। আহত হয় কয়েক শ লোক। এরপর সরকার আড়িয়াল বিলে বিমানবন্দর নির্মাণের প্রকল্পটি স্থগিত ঘোষণা করে।


যে কারণে নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর: বাংলাদেশে আকাশপথে বিমান চলাচলের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তাই নতুন বিমানবন্দর নির্মাণের প্রয়োজন বলে বেবিচক সূত্রে জানা গেছে। ২০১৬ সালের ২১ সেপ্টেম্বর নিপ্পন কোয়ি লিমিটেডের সঙ্গে সমীক্ষা চুক্তির পর বেবিচকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একটি রানওয়ে আছে। এর যাত্রী ধারণের ক্ষমতা বছরে ৮০ লাখ। ২০৩৫ সালের মধ্যে এই বিমানবন্দরের ধারণক্ষমতার সবটুকু ব্যবহৃত হয়ে যাবে। তাই ২০১০ সালে জাতির পিতার নামে নতুন এই বিমানবন্দর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তা ছাড়া ১৯৬৫ সালে শাহজালাল বিমানবন্দরের নকশা করা হয়েছিল। ১৯৮১ সালে বিমানবন্দরটি চালু হয়। এটি প্রায় ৪০ বছরের পুরোনো হয়েছে। আধুনিক বিমানবন্দরের সুযোগ-সুবিধা শাহজালাল বিমানবন্দরে নেই বললেই চলে। তাই নতুন বিমানবন্দর নির্মাণ করা ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় নেই।

আড়িয়াল বিল ঢাকা ও মুন্সিগঞ্জ জেলা এবং পদ্মা নদীর মাঝখানে ছিটমহলসম জলাভূমি অঞ্চল। বিলের দৈর্ঘ্য ২৬ মাইল এবং প্রস্থ ১০ মাইল। অর্থাৎ মোট আয়তন ২৬০ বর্গমাইল বা ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬০০ একর। ২০১০ সালে প্রস্তাবিত প্রকল্পে ১০ হাজার একর জমি বিমানবন্দরের জন্য এবং ১৫ হাজার একর বঙ্গবন্ধু সিটির জন্য অধিগ্রহণ করা হবে। শ্রীনগর উপজেলার ১৪টি মৌজা, নবাবগঞ্জ উপজেলার ১৮টি মৌজা ও দোহার উপজেলার ৭টি মৌজা থেকে এই ২৫ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে।

সম্প্রতি আড়িয়াল বিলে প্রস্তাবিত বিমানবন্দর ফিরিয়ে দিতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ জানান বিকল্প ধারার বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও মুন্সিগঞ্জ-১ (সিরাজদিখান-শ্রীনগর) আসনের সাংসদ মাহী বি চৌধুরী।