শিক্ষকের গায়ে কেরোসিন: শিক্ষার্থীদের ইন্ধনে ছাত্রলীগের একাংশ

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের (ইউএসটিসি) ইংরেজি বিভাগের উপদেষ্টা মাসুদ মাহমুদের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ইন্ধন দিয়েছে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের একাংশ। এমন অভিযোগ করেছেন বেসরকারি এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ শিক্ষার্থী ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

তবে প্রবীণ এই অধ্যাপকের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ছাত্রলীগের একাংশের ইন্ধনের বিষয়টি জানা নেই বলে দাবি করেছেন নগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে একজন গত মঙ্গলবার প্রবীণ এই অধ্যাপকের গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেন। ক্যাম্পাস সূত্র জানায়, কিছু শিক্ষার্থী নিয়মিত ক্লাস না করায় তাঁদের পরীক্ষা দিতে দেননি অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ। এ ছাড়া কয়েকজন শিক্ষকের চাকরিচ্যুতির পেছনে তাঁর ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করা হয়। এসব কারণে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে মাঠে নামে কিছু শিক্ষার্থী।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, ওই শিক্ষার্থীরা অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের বিরুদ্ধে শ্রেণিকক্ষে ‘অপ্রাসঙ্গিকভাবে’ যৌনতার বিষয় তুলে ধরে পক্ষান্তরে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন। তবে এর কোনো প্রমাণ খুঁজে পায়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গঠিত তদন্ত কমিটি।

গত এপ্রিলে বিশ্ববিদ্যালয় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান কামরুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থীদের অভিযোগের বিষয়ে বিশুদ্ধ প্রমাণ পাওয়া যায়নি। শিক্ষার্থীরাও অভিযোগের বিষয়ে দালিলিক প্রমাণ দিতে পারেননি। বরং সাধারণ শিক্ষার্থীরা মাসুদ মাহমুদের পড়ার ধরন নিয়ে মুগ্ধ।

অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষকেরা যে ক্যাম্পাসে অসহায়, তা আমার ঘটনা থেকেই বোঝা যায়। শিক্ষকেরা তো খুবই নিরীহ। তাঁদের শিক্ষা দেওয়া ছাড়া আর কোনো অস্ত্র নেই। কিন্তু এভাবে হলে শিক্ষকদের সুরক্ষা কীভাবে হবে?’ তিনি বলেন, ‘সব তদন্তেই আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। এরপরও যাঁরা আমার বিরুদ্ধে এসব আচরণ করছেন, তাঁরা কেন করছেন তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।’

শিক্ষার্থীদের পেছনে ছাত্রলীগের একাংশ

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, পুলিশ ও ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এপ্রিলের শুরুতে ইউএসটিসির ইংরেজি বিভাগের কিছু শিক্ষার্থী অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন। এই শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর কাছে নিয়ে যান চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সাবেক এক শীর্ষ নেতার অনুসারীরা। শিক্ষার্থীরা গত ২৫ এপ্রিল উপমন্ত্রীকে একটি স্মারকলিপি দেন। সেখানে ইংরেজি বিভাগের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে অধ্যয়ন করা ২৬৫ শিক্ষার্থীর মধ্যে ২২ জনের স্বাক্ষর ছিল।

উপমন্ত্রী বিষয়টি তদন্তের জন্য নগর পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশনা দেন। পুলিশ কমিশনার বিষয়টি তদন্তের দায়িত্ব দেন নগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) বিজয় বসাককে। পুলিশের তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। সবার জবানবন্দি না পাওয়ায় প্রতিবেদন দিতে দেরি হচ্ছে বলে জানান বিজয় বসাক।

ওই সময় অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের চরিত্র হননের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হন তাঁর প্রাক্তন ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা। বিবৃতি দেন দেশের ৫০৭ জন বিশিষ্ট নাগরিক। এরপর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের এ বিষয়ে না জড়াতে সতর্ক করে দেন শিক্ষা উপমন্ত্রী। তবে তাঁরা এখন গোপনে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ইন্ধন দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

>শিক্ষক মাসুদ আহমেদ বলেন, ‘শিক্ষকেরা তো খুবই নিরীহ। কিন্তু এভাবে হলে শিক্ষকদের সুরক্ষা কীভাবে হবে?’

গত ৩০ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে মাসুদ মাহমুদের বিপক্ষে মানববন্ধন ও মিছিল করেন কিছু শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে জড়ো করতে কাজ করেন ছাত্রলীগের ওই অংশের নেতা-কর্মীরা। মিছিলটি ক্যাম্পাসের ভেতর ঢুকতে চাইলে নিরাপত্তারক্ষীরা ফটক বন্ধ করে দেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে বহিরাগত ছয় যুবক দুটি মোটরসাইকেলে করে এসে নিরাপত্তারক্ষীদের ধাক্কা দেন। পাশাপাশি জোর করে কয়েকজন কর্মচারীকেও তাঁরা মানববন্ধনে দাঁড় করিয়ে দেন।

একই সময়ে ফটকের ভেতরে শতাধিক শিক্ষার্থী মাসুদ মাহমুদের পক্ষে মিছিল করেন। তাঁরা ‘উই ওয়ান্ট মাহমুদ স্যার’ বলে স্লোগান দেন। তখন মাসুদ মাহমুদের বিপক্ষে মানববন্ধনকারীরা দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে সরে যান।

গ্রেপ্তার শিক্ষার্থী রিমান্ডে

অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের শরীরে কেরোসিন ঢেলে দেওয়ার বিষয়টি পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন গ্রেপ্তার শিক্ষার্থী মাহমুদুল আলম। এ ঘটনায় নগরের খুলশী থানায় মামলা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার দিলীপ কুমার বড়ুয়া। গতকাল বুধবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ওই শিক্ষার্থীর দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।

শিক্ষকদের ক্ষোভ

মাসুদ মাহমুদকে লাঞ্ছিত করার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। সমিতির সভাপতি মো. জাকির হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক অঞ্জন কুমার চৌধুরী স্বাক্ষরিত ওই বিবৃতিতে বলা হয়, অধ্যাপক মাহমুদকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে কেরোসিন ঢেলে দেওয়া হয়েছে। একজন প্রবীণ শিক্ষকের সঙ্গে এ ধরনের পৈশাচিক কর্মকাণ্ড নিন্দনীয়। তাঁরা ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। 

পাশাপাশি একই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়। বিভাগীয় সভাপতি মাইনুল হাসান চৌধুরীর সভাপতিত্বে সভায় বিভাগের শিক্ষকেরা অংশ নেন। সভায় শিক্ষকেরা বলেন, ইতিপূর্বে অধ্যাপক মাহমুদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার পরও ইউএসটিসি কর্তৃপক্ষ মিথ্যা অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। এর ফলে অপরাধীরা আশকারা পেয়ে তাঁর গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেওয়ার মতো ঘৃণ্য কাজ করার সাহস পেয়েছে।

 আরও পড়ুন...