উখিয়া ও টেকনাফে খাবার-পানির তীব্র সংকটে ৬৭ বন্য হাতি

খাবার ও পানির সংকটে পড়ে শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে উখিয়া ও টেকনাফ বনাঞ্চলের বন্য হাতিগুলো। অতিসম্প্রতি টেকনাফের বনাঞ্চলে।  ছবি: সংগৃহীত
খাবার ও পানির সংকটে পড়ে শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে উখিয়া ও টেকনাফ বনাঞ্চলের বন্য হাতিগুলো। অতিসম্প্রতি টেকনাফের বনাঞ্চলে। ছবি: সংগৃহীত

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বনাঞ্চলে খাদ্য ও পানির তীব্র সংকটে রয়েছে ৬৭টি বন্য হাতি। সীমিত হয়ে পড়েছে হাতি চলাচলের রাস্তা, পানির প্রাকৃতিক উৎস ও আশ্রয়স্থল। এ অবস্থায় দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে হাতিগুলো, করছে হিংস্র আচরণ। লোকালয়ে ঢুকে হানা দিচ্ছে ঘরবাড়িতে। 

বনাঞ্চলের মাঝে বড় অংশজুড়ে রোহিঙ্গাদের ৩২ আশ্রয়শিবির নির্মাণ করায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ও সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে এমন তথ্য জানা গেছে।

আটকে পড়া বন্য হাতিগুলো উন্মত্ত হয়ে রোহিঙ্গা শিবিরে হামলা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বন কর্মকর্তারা।

গত ২১ জুন দুপুরে হাতির অভয়ারণ্য টেকনাফের হোয়াইক্যং জাতীয় উদ্যানের ঐতিহাসিক কুদুমগুহা এলাকায় গিয়ে হাতির দেখা মেলেনি। তবে কয়েকটি পাহাড়ি রাস্তায় হাতির মল ও পায়ের ছাপ দেখা যায়। একই দিন টেকনাফের গেইম রিজার্ভ, বাহারছড়ার গর্জন বন ও উখিয়ার হিমছড়ি জাতীয় উদ্যানে ঘুরে এ প্রতিবেদক বন্য হাতির দেখা পাননি।

হোয়াইক্যং জাতীয় উদ্যান সহব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আলমগীর চৌধুরী বলেন, ৬ হাজার একরের বিশাল এই জাতীয় উদ্যানের অন্তত দেড় হাজার একর দখল করে ইতিমধ্যে রোহিঙ্গাদের দুটি (পুঁটিবনিয়া ও চাকমারকুল) আশ্রয়শিবির গড়ে উঠেছে। শিবির দুটোতে লাখো রোহিঙ্গার বসতি। শিবির তৈরির আগে এসব বনাঞ্চলে ২০-৩০টি হাতির বিচরণ ছিল। এখন মাঝেমধ্যে কুদুমগুহায় কয়েকটি হাতি দল বেঁধে পানি খেতে আসে। হাতিগুলোতে শুকনো মনে হয়েছে।

বনাঞ্চলে রোহিঙ্গা শিবির স্থাপন ও গাছপালা উজাড় হওয়ায় কয়েকটি হাতি অন্যত্র চলে গেছে, এমন ধারণা স্থানীয় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বাসিন্দাদের। তাঁরা জানান, মাঝেমধ্যে রাতের বেলায় হাতির দল চাকমা পল্লিতে এসে গাছের ফলমূল খেয়ে ফেলে। কখনো গোলার ধান খেতে ঘরবাড়িতে হামলা চালায়—যা দুই বছর আগে ঘটেনি। তখন কুদুমগুহা, হোয়াইক্যং, টেকনাফের গেম রিজার্ভ এলাকায় দিনের বেলায়ও হাতির দলের বিচরণ চোখে পড়ত।

বন বিভাগ সূত্রমতে, হিমছড়ি বনাঞ্চলের হাতিগুলো রোহিঙ্গা শিবির অতিক্রম করে দক্ষিণে টেকনাফ বনাঞ্চলের দিকে যেতে পারে না। এসব এলাকার হাতিগুলো খাবারের সন্ধানে পূর্বদিকে রামুর দিকে চলে যাচ্ছে। এ পথে যেতে রোহিঙ্গা শিবির পড়ে না। অন্যদিকে টেকনাফ বনাঞ্চলের বন্য হাতিগুলো রোহিঙ্গা শিবির অতিক্রম করে উত্তর দিকের হিমছড়ি কিংবা রামুর দিকে যেতে পারছে না। পূর্বদিকে নাফ নদী আর পশ্চিম দিকে বঙ্গোপসাগর থাকায় হাতিগুলো মূলত টেকনাফে অবরুদ্ধ হয়ে আছে।

>রোহিঙ্গা শিবিরের কারণে সীমিত হয়ে পড়েছে হাতি চলাচলের রাস্তা, পানির প্রাকৃতিক উৎস ও আশ্রয়স্থল। দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে হাতিগুলো।

কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির বলেন, টেকনাফ থেকে উখিয়ার হিমছড়ি পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার লম্বা বনাঞ্চলে বিচরণ করে ৬৭টি হাতি। কিন্তু বনাঞ্চলের মাঝের ৬ হাজার ১৬২ একরে বিশ্বের সর্ববৃহৎ রোহিঙ্গা শিবির গড়ে ওঠায় হাতিগুলো বিপদে পড়েছে। হাতিগুলো শরণার্থী শিবির অতিক্রম করে এপার–ওপার হতে পারছে না। 

স্থানীয় বনকর্মীরা বলেন, ১২০ জনের পাঁচটি পৃথক দল দিন–রাত ২৪ ঘণ্টা টহল দিয়েও এই হোয়াইক্যং জাতীয় উদ্যানের গাছপালা রক্ষা করতে পারছে না। গরমে হাতির প্রাকৃতিক জলাশয়গুলোর পানিও শুকিয়ে গেছে।

বন বিভাগের তথ্যমতে, ২০১০ সালের ২৪ মার্চ হাতি সংরক্ষণের জন্য ২৮ হাজার ৬৮৮ একর বনভূমি নিয়ে ‘টেকনাফ গেইম রিজার্ভ’ গঠন হয়। 

প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আর্ন্তজাতিক সংস্থাগুলোর জোট আইইউসিএন বলছে, বন্য এশীয় হাতি বাংলাদেশের মহাবিপন্ন প্রজাতির প্রাণী। আইইউসিএন, বাংলাদেশ–এর কান্ট্রি ডিরেক্টর রাকিবুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন্য হাতিরা টেকনাফ ও ইনানীর যে বনভূমিতে আটকে পড়েছে সেখানকার বনের স্বাস্থ্যকে আমাদের আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়ে রক্ষা করতে হবে। আর কক্সবাজার এলাকায় রোহিঙ্গা শিবির ছাড়াও রেললাইন, সড়কসহ বেশকিছু অবকাঠামো নির্মিত হচ্ছে। ফলে হাতির চলাচল ও বেঁচে থাকার সামগ্রিক পরিকল্পনাকে এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। না হলে হাতিগুলো মানুষের বসতি এলাকায় বেশি করে আসা শুরু করবে। আর এতে স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘাত বাড়বে।’ 

একের পর এক ঘটনা

গত ২২ জুন রাতে রামুর খুনিয়াপালং ইউনিয়নের কায়দং এলাকায় বন্য হাতির আক্রমণে আবুল বশর (৪৫) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়। খুনিয়াপালং ইউপির চেয়ারম্যান আবদুল মাবুদ বলেন, খাবার সংকটে পড়ে উখিয়ার বনাঞ্চল থেকে পাঁচটি বন্য হাতি রামুতে এসে রাত ১০টার দিকে আবুল বশরের বাড়িতে হানা দেয়।

পুলিশ ও বন বিভাগের তথ্যমতে, গত দুই বছরে টেকনাফের বাহারছড়া ও উখিয়ার ইনানী বনাঞ্চলে মারা গেছে দুটি বন্য হাতি। বন বিভাগের দাবি বার্ধক্যজনিত কারণে হাতি দুটোর মৃত্যু হয়। একই সময় হাতির আক্রমণে উখিয়া, টেকনাফ ও রামুতে মারা গেছেন ২৫ জন। এর মধ্যে ১৩ জন রোহিঙ্গা।