নাটবল্টু ঢিলা, নষ্ট স্লিপার, তবু চলছে ট্রেন

রেলসেতুর নিচের গার্ডারের সঙ্গে কাঠের স্লিপার আটকানো থাকে। আর স্লিপারের ওপর বসানো থাকে রেললাইন, যা আটকানো হয় ক্লিপ দিয়ে। পাশাপাশি দুটি রেলসেতুর অধিকাংশ কাঠের স্লিপার পচে নষ্ট হয়ে গেছে। সেখানে স্লিপার ও গার্ডার আটকানোর জন্য ব্যবহৃত বেশির ভাগ নাটবল্টুও নেই। যে কয়টি আছে তা–ও নড়বড়ে। হাত দিয়ে টানলেই খুলে যায়। কিছু কিছু জায়গায় রেললাইন আটকানোর ক্লিপও নেই।

এই দুরবস্থা মৌলভীবাজারের কুলাউড়া এবং লংলা রেলস্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানে ফানাই নদ ও রাউৎগাঁও ছড়ার ওপর অবস্থিত দুটি সেতুর। এ অবস্থার মধ্যেও ওই দুটি সেতু দিয়ে প্রতিদিন সিলেট, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও আখাউড়ায় ২২টি ট্রেন আসা-যাওয়া করে।

গত বুধবার সরেজমিন দেখা গেছে, রাউৎগাঁও সেতুর দৈর্ঘ্য ১৫ ফুট। এতে কাঠের স্লিপার আছে মাত্র ৯টি। এর মধ্যে আবার ৫টিই নষ্ট। প্রতিটি স্লিপারের দুই পাশে রেললাইনের সঙ্গে ৮টি করে ক্লিপ থাকার কথা। কিন্তু কোনোটিতে ৪টি আবার কোনোটিতে একেবারেই নেই। স্লিপারগুলো নড়বড়ে। একটি আরেকটির সঙ্গে যাতে যুক্ত না হয়, সে জন্য সেগুলোর ওপর কাঠের ফালি বসিয়ে পেরেক ঠুকে দেওয়া হয়েছে। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ঢাকা থেকে সিলেটগামী আন্তনগর পারাবত এক্সপ্রেস ট্রেন অতিক্রম করার সময় সেতুটি কেঁপে ওঠে।

রেললাইনের পাশের রাউৎগাঁও গ্রামের বাসিন্দা স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির শিক্ষার্থী মাসহুদ আলম বলেন, ব্রিজটা ছোট। কিন্তু রিস্ক (ঝুঁকি) বড়। পর্যাপ্ত সুরক্ষা না থাকায় যেকোনো সময় স্লিপার বা রেললাইন ডিসপ্লেস (সরে গিয়ে) হয়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

রাউৎগাঁও সেতু থেকে প্রায় ২০০ মিটার দূরে ২১৭ নম্বর ফানাই সেতু। এর দৈর্ঘ্য ৪৫ ফুট। সেটিতে ৫৮টি কাঠের স্লিপারের ২৮টিই ক্ষয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। 

গার্ডারের সঙ্গে স্লিপার আটকানোর নাটবল্টু হাত দিয়ে টানলেই বেরিয়ে পড়ে। ফানাই রেলসেতুতে।  ছবি: প্রথম আলো
গার্ডারের সঙ্গে স্লিপার আটকানোর নাটবল্টু হাত দিয়ে টানলেই বেরিয়ে পড়ে। ফানাই রেলসেতুতে। ছবি: প্রথম আলো

প্রায় অর্ধেকে গার্ডার-স্লিপারের সংযোগস্থলে নাটবল্টু নেই। ৫৮টি স্লিপারে দুটি করে ১১৬টি নাটবল্টু থাকার কথা। আছে মাত্র ৬০টি। সেতু থেকে পাশের চৌধুরী বাজার রেলগেট পর্যন্ত রেললাইন ধরে হেঁটে হেঁটে অন্তত ২০০ ক্লিপ পাওয়া যায়নি। ওই সেতুতেও স্লিপারের জায়গা বাঁশের ফালি বসানো।

স্থানীয় ভাটুত্ব গ্রামের বাসিন্দা এলিম মিয়া ও নর্তন গ্রামের খন্দকার লুৎফুর রহমান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সেতুটি বেহাল। কিন্তু সংস্কার হচ্ছে না। সেতুটিকে তাঁরা ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেন। নষ্ট স্লিপারগুলো সরিয়ে নতুন স্লিপার স্থাপন করলে ঝুঁকি থাকত না।

নর্তন গ্রামের ট্রাকচালক সাইফুল ইসলাম প্রতিদিন বিকেলে চৌধুরী বাজার থেকে মাছ-তরকারি কিনে এ সেতু পার হয়ে বাড়ি ফেরেন। সাইফুল বলেন, রেললাইনে সংযোগস্থলে প্রায়ই নাটবল্টু ঢিলা থাকে। তিনি হাত দিয়ে সেগুলো শক্ত করে লাগিয়ে যান। ট্রেন আসা-যাওয়ায় ঝাঁকুনিতে পুনরায় সেগুলো ঢিলা হয়ে যায়।

সেতু দেখাশোনার দায়িত্ব রেলওয়ের পুরকৌশল বিভাগের। বেলা তিনটার দিকে কুলাউড়া রেলস্টেশনের কাছে ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী (পথ) মো. জুলহাসের কার্যালয়ে গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও ফোন ধরেননি।

পুরকৌশল বিভাগের কি-ম্যানদের (রেললাইন দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তি) দলনেতা সেবুল আলী বলেন, ২১৬ ও ২১৭ নম্বর সেতুতে কিছু স্লিপার নষ্ট আছে। দু-চার বছর পরপর স্লিপার বদলানো হয়। নতুন স্লিপারের জন্য নোট দেওয়া হয়েছে। আর নাটবল্টু প্রতিদিনই চেক করা হয়। এরপরও সমস্যা থাকলে খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

রেলওয়ের ঢাকার প্রধান দপ্তরের বিভাগীয় প্রকৌশলী-২ আহসান জাবির প্রথম আলোকে বলেন, ১ হাজার কাঠের স্লিপার আনা হয়েছে। সিলেট বিভাগের যেসব স্থানে স্লিপার একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে, সেখানে সেগুলো স্থাপন করা হবে। এ ছাড়া সিলেট বিভাগের ১৮০টি ছোট-বড় রেলসেতু নতুন করে নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। কুলাউড়ার দুটি সেতুর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।