বর্জ্যে ছয় গ্রামের মানুষের ভোগান্তি

ময়লার স্তূপ থেকে উচ্ছিষ্ট খাচ্ছে গরু-ছাগল। কুমিল্লা জেলার আদর্শ সদর উপজেলার ঝাকুনিপাড়া এলাকায়।  ছবি: প্রথম আলো
ময়লার স্তূপ থেকে উচ্ছিষ্ট খাচ্ছে গরু-ছাগল। কুমিল্লা জেলার আদর্শ সদর উপজেলার ঝাকুনিপাড়া এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ফেলার স্থান জেলার আদর্শ সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের দৌলতপুর-ঝাকুনিপাড়া গ্রামে। ময়লা ফেলার ওই স্থানে পুকুর কেটে মাছ চাষ করছেন নগর ভবনের একজন ঠিকাদার। 

নগরের বর্জ্য ফেলার জন্য বরাদ্দকৃত জায়গার অর্ধেকের বেশি অংশজুড়ে রয়েছে তিনটি পুকুর। সাত বছর ধরে সেখানে মাছ চাষ চলছে। এ কারণে ময়লা–আবর্জনা পুকুরের পাড়, ওই এলাকার বাসিন্দাদের বাড়ির আশপাশে ও সড়কের পাশে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। ফলে আশপাশের অন্তত ছয় গ্রামের ২০ হাজার মানুষ দুর্গন্ধে নাকাল হচ্ছেন। প্রতিদিন নাক চেপে ওই এলাকা পার হতে হয় তাঁদের। তবে ঠিকাদারের দাবি, নগর ভবন থেকে ১২ বছরের জন্য ইজারা নিয়েই তিনি মাছ চাষ করছেন। 

এদিকে বাড়ির আশপাশ ও সড়কের লাগোয়া অংশে ময়লা ফেলার কারণে এলাকাবাসী ২০১৭ সালের ২০ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সেখানে ময়লা ফেলতে বাধা দিয়েছিলেন। পরে প্রশাসন ও মেয়রের হস্তক্ষেপে আবার ময়লা ফেলা হয়। 

নগর ভবনের অন্তত তিনজন কর্মকর্তা বলেন, কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার ঝাকুনিপাড়া গ্রামের ১০ একর জায়গা অধিগ্রহণ করে সিটি করপোরেশন প্রতিদিন অন্তত ৮০ থেকে ১০০ মেট্টিক টন বর্জ্য ফেলছে। নগরের ২৭টি ওয়ার্ডের ময়লা–আবর্জনা প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ফেলা হয়। এতে ঝাকুনিপাড়া, দৌলতপুর, বাজগড্ডা, খামারকৃষ্ণপুর, সুয়ারা ও জগন্নাথপুরসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। ময়লা ফেলার জায়গার তিন দিকে আংশিক সীমানাপ্রাচীর থাকলেও উত্তর দিকে কোনো সীমানাপ্রাচীর নেই। পূর্ব ও পশ্চিম দিকে অর্ধেক অংশে সীমানাপ্রাচীর নেই। ময়লার স্তূপের পাশ দিয়েই বিবিরবাজার স্থলবন্দর সড়ক। ফলে এই এলাকার মানুষকে নিত্যদিন ভোগান্তি পোহাতে হয়। নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ময়লা ফেলার স্থানে অবাধে গরু–ছাগল ঢুকে পড়ে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, অপরিকল্পিতভাবে ময়লার স্তূপ রাখা হয়েছে। সড়কের পাশেও ময়লা জমা আছে। কিন্তু ভেতরের বিস্তীর্ণ এলাকা খালি পড়ে আছে। সেখানে তিনটি পুকুরের স্থলে বর্তমানে একটি পুকুরে মাছ চাষ হচ্ছে। 

এলাকাবাসীর দাবি, সড়কের পাশে ময়লার স্তূপ না করে দক্ষিণ মাথা থেকে পুকুরের মধ্যে ময়লা ফেলতে হবে। এতে গন্ধ ছড়াবে না। কিন্তু বিস্তীর্ণ জায়গা খালি রেখে আবাসিক এলাকার গা ঘেঁষে ময়লা ফেলা হচ্ছে। এ ছাড়া ১০ একর জায়গার পাঁচ একরের মধ্যে তিনটি পুকুর রয়েছে। ওই পুকুরে মাছ চাষ করছেন কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ঠিকাদার মো. মোতাহের হোসেন। 

অভিযোগ প্রসঙ্গে মোতাহের হোসেন বলেন, ‘ঝাকুনিপাড়া ময়লা ফেলার স্থানের ঠিকাদার ছিলাম আমি। তখন মাটি কেটে এর চারপাশে বাঁধ দেওয়া হয়। ওই সময়ে তিনটি পুকুর করা হয়। এরপর নগর ভবন থেকে ১২ বছরের জন্য তিনটি পুকুর ইজারা নিয়েছি। ইতিমধ্যে সাত বছর পার হয়েছে। এ সম্পর্কিত নথি আমার কাছে রয়েছে। বেআইনিভাবে কোনো কিছু করছি না। দুটি পুকুরে এখন ময়লা ফেলা হচ্ছে। একটি পুকুরে মাছ চাষ হচ্ছে। সেখান থেকেও চুক্তি বাতিল করে চলে আসব।’ 

ঝাকুনিপাড়া গ্রামের মো. বাবুল মিয়া বলেন, ‘ময়লার কারণে বাড়িতে থাকতে পারছি না। এলাকার লোকজন মেয়ে বিয়ে দিতে পারছেন না। তার ওপর পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। অনেকে শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়েছে। ময়লা রাখার ভেতরে পুকুর করা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত হয়নি। আমরা এই অভিশাপ থেকে মুক্তি চাই।’ 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কুমিল্লা জেলা শাখার সভাপতি ও কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোসলেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ওই এলাকার জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে। পরিকল্পনা নিয়ে ময়লার স্থান নির্ধারণ করা হোক। এতে পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব হবে। 

জগন্নাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদ বলেন, ‘অপরিকল্পিতভাবে ময়লা ফেলা হচ্ছে। দুর্গন্ধে মানুষ বাড়িঘরে থাকতে পারছে না। উত্তরের বাতাস শুরু হলে ময়লার উত্কট গন্ধ দৌলতপুর এলাকায় অবস্থিত ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় পর্যন্ত আসে। সামনের কোরবানির ঈদে সব বর্জ্য এখানে ফেলা হবে। তখন ১৫ দিন গন্ধে এলাকার লোকজন টিকতে পারবেন না। পরিকল্পিতভাবে ময়লা ফেলা হলে এমনটা হতো না। 

সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. মনিরুল হক বলেন, ‘ময়লার গন্ধ যেন আশপাশে না ছড়ায় সেদিকে লক্ষ রাখা হবে। উত্তর পাশে দেয়াল করা হবে। তখন ময়লা যাবে না। জাইকাকে দিয়ে আমরা পরিকল্পিতভাবে কিছু করব।’