লাউয়াছড়া বনের প্রাণী বাঁচাতে বিকল্প সড়ক হচ্ছে

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতরে দিয়ে চলে যাওয়া রেলপথ। ছবি: প্রথম আলো
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতরে দিয়ে চলে যাওয়া রেলপথ। ছবি: প্রথম আলো

মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে একটি রেললাইন ও একটি সড়ক চলে গেছে। উদ্যানটি বন্য প্রাণীতে ভরপুর হওয়ায় রাস্তা পারাপারের সময় প্রায়ই গাড়িচাপায় বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির বিভিন্ন প্রাণী মারা পড়ছে। বন্য প্রাণী বাঁচাতে উদ্যানের ভেতরের শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়ক বন্ধ করে বিকল্প সড়ক চালুর চিন্তাভাবনা চলছে অনেক দিন ধরে। কিন্তু তা বাস্তবায়ন বিলম্বিত হচ্ছে।

সম্প্রতি বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ এবং সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ বিকল্প সড়ক চালুর বিষয়ে একটি যৌথ জরিপ পরিচালনা করেছে। এতে শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়কের শ্রীমঙ্গলের রাধানগর এলাকা থেকে কমলগঞ্জের বটতলা পর্যন্ত একটি বিকল্প সড়ক নির্মাণ করা সম্ভব বলে জরিপে নির্ধারণ করা হয়েছে। আঁকাবাঁকা বিকল্প সড়কটির বিভিন্ন স্থান সোজা করে দিলে সময়ের খুব একটা হেরফের হবে না।

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সরকার ১৯৯৬ সালে ১ হাজার ২৫০ হেক্টরের চিরহরিৎ ও মিশ্র চিরহরিৎ লাউয়াছড়া বনটি জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করে। এই বনে উল্লুক, বানর, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, বনমোরগ, বনরুই, মায়া হরিণ, মেছো বাঘ, বন্য শূকর, অজগরসহ অনেক প্রজাতির বিরল, বিপন্ন ও বিপন্নপ্রায় প্রাণী আছে। এখানে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রকারের উভচর প্রাণী, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি এবং ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। উদ্ভিদ ও প্রাণীবৈচিত্র্যে ভরপুর এ রকম একটি বনের ভেতর দিয়ে চলে গেছে গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা-সিলেট রেলপথ এবং শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়ক। রেল ও সড়কপথের দুপাশেই উদ্যান। বন্য প্রাণীরা সড়কের এ-পাশ থেকে ও-পাশে নিয়মিত আসা-যাওয়া করে। এ ক্ষেত্রে রাতের বেলাতেই বন্য প্রাণীর বিচরণ বেশি। রাস্তা পারাপারের সময় হঠাৎ করে সামনে চলে আসা দ্রুতগামী যানবাহনের আলোতে প্রাণীরা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তখন দ্রুতগামী গাড়ির আঘাতে অনেক বন্য প্রাণী মারা পড়ছে। প্রায়ই পথচারীরা সড়কের ওপর, সড়কের পাশে বন্য প্রাণীর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখছেন। এই রাস্তা যখন তৈরি হয়, সে সময় যানবাহন কম ছিল। এখন প্রতিদিন এই সড়কে ২০০ থেকে ৩০০ যানবাহন চলাচল করে। প্রতি মাসেই কোনো না কোনো বিরল প্রাণীর মৃত্যু হচ্ছে সড়কে।

স্থানীয় লোকজন জানান, ঢাকা-সিলেট রেললাইন এবং শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়কে প্রতিবছর অন্তত ৪০ থেকে ৫০টি বিভিন্ন বিরল প্রজাতির বন্য প্রাণী মারা পড়ছে।

এই বাস্তবতায় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়কটি বন্ধ করে বিকল্প সড়ক চালুর চিন্তাভাবনা চলছে অনেক দিন ধরে। ২০১৭ সালের ২ জুলাই ‘লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, রেমা-কালেঙ্গা বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য এবং রাতারগুল জলজ বন’ সুরক্ষায় করণীয় বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এক পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের প্রাণী রক্ষায় উদ্যানের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তা সরিয়ে বিকল্প সড়ক নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সিদ্ধান্তে ছিল লাউয়াছড়ায় রাতে গাড়ি চাপায় পিষ্ট হয়ে বন্য প্রাণীর মৃত্যু প্রতিরোধে জাতীয় উদ্যানের বাইরে দিয়ে বিকল্প সড়ক নির্মাণ বা উন্নয়ন করা। বিকল্প সড়ক নির্মাণ বা উন্নয়নের জন্য সংশ্লিষ্ট স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি), সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ, চা-বাগান কর্তৃপক্ষ, বন বিভাগ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সমন্বয়ে তা বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু করা। শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়কের ৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার পড়েছে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান এলাকায়। কিন্তু এত দিনেও এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি। বন্য প্রাণীর মৃত্যুর মিছিলও থামছে না।

বন বিভাগ ও সওজ সূত্রে জানা গেছে, গত ২৮ জুন বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ এবং সওজ শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়কের বিকল্প হিসেবে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের বাইরে দিয়ে যে সব সড়ক গেছে, সেই সড়কগুলোর ওপর এক প্রাথমিক জরিপ চালিয়েছে। এই জরিপ দলটি শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়কের শ্রীমঙ্গল উপজেলার গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট অ্যান্ড গলফের সামনে থেকে রাধানগর হয়ে যে রাস্তা গেছে, সেই রাস্তাটিকে শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সড়কের কমলগঞ্জ উপজেলার বটতলা নামক স্থানের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার বিষয়ে প্রাথমিকভাবে ঠিক করেছে। এতে রাস্তার দূরত্ব ৮ থেকে ১০ কিলোমিটারের মতো হতে পারে। বিকল্প হিসেবে এই রাস্তা করা হলে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান পুরোপুরি সড়কপথ থেকে আলাদা হয়ে যাবে। তখন উদ্যানের ভেতরের সড়কটি বন্ধ করে দেওয়া হবে। এ ছাড়া উদ্যান এলাকা থেকে নূরজাহান চা-বাগান হয়ে যে সড়কটি গেছে, সেটিও বন্ধ করা হবে। যানবাহনে বন্য প্রাণী মৃত্যুর আশঙ্কা থাকবে না।

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মো. আনিসুর রহমান আজ রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সওজ ও আমরা যৌথ সার্ভে করেছি। অনেক রাস্তা ঘুরে দেখেছি। প্রাথমিকভাবে ঠিক করা হয়েছে, রাধানগর হয়ে যে রাস্তাটি গেছে, সেটি গিয়ে কমলগঞ্জের বটতলায় উঠবে। এতে লাউয়াছড়া পুরোপুরি আলাদা হয়ে যাবে। বন্য প্রাণী পারাপারে আর সমস্যা হবে না।’
এসিএফ বলেন, ‘লাউয়াছড়া বন্য প্রাণীতে ভরপুর। এত প্রাণী আর কোথাও নেই। বিকল্প রাস্তা হওয়াটা দরকার। চিতা বিড়ালসহ বিপন্ন অনেক ধরনের প্রাণী মারা যাচ্ছে। প্রতি মাসেই কোনো না কোনো প্রাণী মারা যাওয়ার খোঁজ মিলছে। সব সময় তার হিসাব রাখা যাচ্ছে না। সড়কপথ বন্ধ হয়ে গেলে ঢাকা-সিলেট রেল লাইন না সরানো পর্যন্ত রেল লাইনের দুপাশে বেড়া দেওয়া হবে, যাতে বন্য প্রাণী রেললাইনে উঠতে না পারে। তাদের নিরাপদ চলার ব্যবস্থা করা হবে।’

সওজ মৌলভীবাজারের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. রাশেদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে ঠিক করা হয়েছে রাধানগর হয়ে বটতলা পর্যন্ত বিকল্প সড়ক নির্মাণ করার। এতে হয়তো একটু ঘুরে যাবে। এতে বর্তমান সড়কের চেয়ে পাঁচ মিনিটের বেশি সময় লাগতে পারে। বিকল্প রাস্তার বর্তমান অবস্থা আঁকাবাঁকা। অ্যালাইনমেন্ট ঠিক করা হবে। এদিক দিয়ে বিকল্প রাস্তা করা সম্ভব। এখন বন বিভাগ থেকে সওজের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে জানালে কর্তৃপক্ষ আমাদের জানাবে। তার পরই রাস্তা নির্মাণের কাজ বাস্তবায়ন হবে।’