নগরগুলো নারী ও শিশুবান্ধব নয়

‘নারী ও শিশুবান্ধব নগর সেবা এবং সুশাসন’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা। ছবি: প্রথম আলো
‘নারী ও শিশুবান্ধব নগর সেবা এবং সুশাসন’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকেরা। ছবি: প্রথম আলো

নগরগুলো নারী ও শিশুবান্ধব নয়—এ কথা বলেছেন ঢাকায় আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকের আলোচকেরা। তাঁরা বলেন, নগরগুলোতে বাসস্থান, কর্মস্থল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও চলাফেরা—এই চার জায়গায় নারী ও শিশুর জন্য নিরাপত্তা জরুরি। সমস্যায় পড়লে প্রতিকার চেয়ে প্রতিকার মেলে না বলে অনেকেই কথা বলে না। নগরগুলোতে প্রতি ওয়ার্ডে ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে ডে–কেয়ার সেন্টার গঠন করার সুপারিশ করেছেন বিশিষ্টজনেরা।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে আজ রোববার সকালে ‘নারী ও শিশুবান্ধব নগর সেবা এবং সুশাসন’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে নীতিনির্ধারকসহ আলোচকেরা এসব কথা বলেন। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) ও পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সহযোগিতায় এ বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো। বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
বৈঠকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, শুধু উঁচু উঁচু ভবন তৈরি করলেই নগরায়ণ হবে না। একটি নগরী যদি নারী ও শিশু পরিবেশবান্ধব না হয়, নারী ও শিশুর জন্য নগরে শারীরিক সুস্থতা, মানসিকতা ও সম্মানের সঙ্গে থাকতে না পারে, তাহলে সমাজ স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে না। নগরে এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে মা ও শিশু নিরাপদ এবং সুস্থ পরিবেশে সেখানে বেড়ে ওঠে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ও জ্যেষ্ঠ সচিব শামসুল আলম বলেন, নগরীতে নারী ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা, বিনোদন, খোলা মাঠের ব্যবস্থা করা—এগুলোই আমাদের চাওয়া। এ দেশে ডে–কেয়ার সেন্টারের সুবিধা প্রতিষ্ঠা করা উচিত। পাড়া–মহল্লায় বিউটি পারলার গড়ে উঠেছে। অথচ পর্যাপ্ত ডে–কেয়ার সেন্টার নেই। পারলারের কাজ করার প্রশিক্ষণ সহজলভ্য। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ডে–কেয়ার সেন্টার বিষয়ে কোনো কোর্স কি প্রশিক্ষণের জন্য আছে?
শামসুল আলম বলেন, কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনো কোর্স নেই, ডে–কেয়ারে যারা কাজ করবে, সেই ট্রেনিংয়ের জায়গা কোথায়? দ্রুত সারা দেশে শিশু রক্ষণাবেক্ষণে চাইল্ড কোর্স করা হোক। ডে–কেয়ার সেন্টারের উদ্যোক্তাদের জন্য সরকার ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে। যারা সেন্টার খুলবে, সরকার তাদের সহযোগিতা দেবে।

বেসরকারি সংগঠন সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের (সিইউএস) চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, নগরীতে নারী ও শিশুর নিরাপত্তার বিষয়টি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অহরহ নারী ধর্ষণ, খুনের খবর দেখতে হয়। নগরীতে যেকোনো উন্নয়ন করা হলে তার কেন্দ্রে যেন মানুষ থাকে, মানুষ যেন উপকারভোগী হয়, সেটা দেখতে হবে। নগর সেবায় পানি, পয়োনিষ্কাশন, বিদ্যুৎ, বিনোদন, পরিবহন, নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য—এই সেবাগুলো ঠিকমতো দেওয়া হচ্ছে কি না, সেগুলো দেখতে হবে।

গোলটেবিলে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দেশের নগরগুলোতে উন্নয়ন হচ্ছে, নগরগুলোর বিস্তার হচ্ছে। তবে নগরে জীবনমান উন্নয়ন করা দরকার। নগরগুলো যে দ্রুতগতিতে এগিয়েছে, নগরের স্বাস্থ্যব্যবস্থা অত দ্রুতগতিতে উন্নত হয়নি। একটি নগরে বাসস্থান, কর্মস্থল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও চলাফেরা—এই চারটি জায়গায় নারী ও শিশুর নিরাপত্তা খুব বেশি দরকার। নারী ও শিশুরা এসব জায়গায় সমস্যায় পড়লে তাদের প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ করা জরুরি। প্রতিকার পায় না বলে অনেকেই কথা বলে না।

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (ডানে)। তাঁর পাশে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ও জ্যেষ্ঠ সচিব শামসুল আলম। ছবি: প্রথম আলো
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দেন গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (ডানে)। তাঁর পাশে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ও জ্যেষ্ঠ সচিব শামসুল আলম। ছবি: প্রথম আলো

হোসেন জিল্লুর বলেন, সুশাসন শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, সুশীল সমাজেরও দায়িত্ব প্রতিকার চাওয়ার ব্যাপারে পরিস্থিতি উন্নত করা। প্রশাসনিকভাবে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। নগরগুলোতে নারী ও শিশুদের জন্য উন্মুক্ত জায়গা তৈরি করা জরুরি, যেখানে তারা প্রতিদিন সময় কাটাতে পারবে।

জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) সামাজিক নীতি বিশেষজ্ঞ হাসিনা বেগম বলেন, সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের ফাঁক এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কম শক্তিশালী। পরিকল্পনাতে ঘাটতি আছে। মাতৃস্বাস্থ্য, শিশু ও মায়েদের পুষ্টি নিয়ে কাজের অভাব আছে। ২০১৬ সালের বিবিএসের এক জরিপে এসেছে, শহরে ২৬ শতাংশ শিশু খর্বাকৃতির। সামাজিক নিরাপত্তার বাজেট কম শহরে গ্রামের তুলনায়। ভালো সেবা দিতে সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তথ্য ও সেবার ঘাটতি আছে। এগুলো সমন্বয় করতে হবে।

হাসিনা বেগম বলেন, ডে–কেয়ার গার্মেন্ট কারখানাগুলোতে অনেক হয়েছে। তবে অন্যান্য সরকারি বেসরকারি খাতে ডে–কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে না। অনেক কারখানায় ডে–কেয়ার সেন্টার ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায়। অন্যান্য সরকারি–বেসরকারি খাতে ডে–কেয়ার সেন্টার নেই বললেই চলে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতগুলোতে ডে–কেয়ার সেন্টার বাড়াতে হবে। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতগুলোতে ডে–কেয়ার প্রতিষ্ঠা করতে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ কাজ করতে পারে। কমিউনিটি স্বাস্থ্য ক্লিনিকগুলোতে সেবা পেতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও সিটি করপোরেশনের সমন্বয় জরুরি।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক সারওয়ার জাহান বলেন, শহরগুলো নাগরিকবান্ধব কি না, এরপর প্রশ্ন আসবে, শহরগুলো নারী ও শিশুবান্ধব কি না। এই শহরে জেন্ডার সেনসেটিভ পরিকল্পনা নেই। রাষ্ট্রের দায়িত্ব নাগরিকদের সেবার ওপর নজর দেওয়া। রাষ্ট্র নজর না দিলে মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শিশুরাই দেশের ভবিষ্যৎ। তাই নগরীতে শিশুরা কীভাবে বেড়ে উঠছে, সেখানে নজর দিতে হবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ইশরাত ইসলাম বলেন, অ্যাপার্টমেন্ট কেনার মাধ্যমে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হলো। অথচ নগরগুলোতে উন্মুক্ত স্থান গড়ার লক্ষ্যে কোনো সুযোগ তৈরি করা হলো না কেন? ঢাকার অনেক মাঠের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। অথচ এলাকাভিত্তিক ছোট জায়গাগুলোর একটু বিনিয়োগ ও সংস্কার করে ব্যবহারের উপযোগী করা যায়। তবে সেসব জায়গাতেও নারী ও শিশুর জন্য আলাদা নিরাপত্তাব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাঠ ও উন্মুক্ত জায়গাগুলো নারী ও শিশুদের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে বলে পরামর্শ দেন তিনি।
নগরগুলোর জনসংখ্যা দিন দিন বাড়ছে উল্লেখ করে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রধান মো. মাহবুবুল আলম সিদ্দিকী বলেন, ২০২৯ সাল নাগাদ নগরগুলোতে জনসংখ্যা আট কোটির বেশি ছাড়িয়ে যাবে। এই জনগোষ্ঠীর সেবা নিশ্চিত করতে সরকারি, বেসরকারি এবং উন্নয়ন সংস্থাগুলোর বিভিন্ন উদ্যোগের সমন্বয় ঘটাতে হবে। সমন্বয়টাই বড় চ্যালেঞ্জ।
ব্রিটিশ উন্নয়ন সহযোগী ডিএফআইডির সামাজিক উন্নয়ন উপদেষ্টা আনোয়ারুল হক বলেন, শহরের প্রান্তিক মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এবং নগরের উন্নয়নে আষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় স্পষ্ট অবস্থান জরুরি। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার খবর গণমাধ্যমে প্রায়ই দেখা যায়। কিন্তু শহরের প্রান্তিক নারী ও শিশুরা সারাক্ষণ উৎকণ্ঠায় থাকে। নিরাপদ খাদ্য, পানি, পয়োনিষ্কাশন, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা তাদের দরকার। শহুরে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, কিংবা নিম্নবিত্ত নারীরা তাঁদের সন্তানদের কর্মস্থলে কোথায় রাখবেন, সে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন। নগর পরিকল্পনায় শারীরিকভাবে চ্যালেঞ্জ নারী ও শিশুদের কথা কী ভাবা হয়, তিনি প্রশ্ন রাখেন।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) দারিদ্র্য ও নগরায়ণ বিভাগের প্রধান আশেকুর রহমান বলেন, দেশের শহর ও নগরগুলো নারী ও শিশুবান্ধব নয়। কতটা বান্ধব, তা নিয়ে আলোচনা করলে খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার সুযোগ নেই। নগরগুলোতে যে শ্রেণিবৈষম্য ও বিভক্তি আছে, তা বহুতল ভবনের ছাদে উঠলেই বোঝা যায়। উঁচু ভবনগুলোর পাশেই হাজার হাজার বস্তিঘর চোখে পড়ে। এসব বস্তিবাসীর সংখ্যা কত, তা–ও নির্দিষ্ট পরিসংখ্যানের অভাব আছে। ঢাকার গণপরিবহন নারীবিদ্বেষী, নারীবান্ধব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেক উদাহরণ এ সম্পর্কে আমরা জানি, দেখতে পাই। কিশোরীদের জন্য উন্মুক্ত জায়গা নেই, যেখানে তারা নিয়মিত খেলাধুলা করতে পারে। এ সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। নগরীতে নারী ও শিশুর নিরাপত্তার বিষয়টি রাজনৈতিক। এটাই প্রধান চ্যালেঞ্জ।

ইউএন হ্যাবিট্যাটের নগর পরিকল্পনা ও নকশা বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মসূচি সমন্বয়ক মো. সোহেল রানা বলেন, একটি নগরীতে নারী ও শিশুর জন্য আলাদা উন্মুক্ত স্থান খুব জরুরি। কিন্তু আমরা ব্যক্তিস্বার্থে ইমারত বা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে ফেলেছি। যেসব উন্মুক্ত স্থান বা খেলার মাঠ আছে, সেগুলোতে কি নারী ও শিশুর যথেষ্ট প্রবেশগম্যতার সুযোগ আছে? টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় নারী ও শিশুর উন্মুক্ত স্থানে হাঁটাচলা, খেলাধুলা, সময় কাটানোর একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করা আছে।
পিপিআরসির গবেষণা সহযোগী উমামা জিল্লুর বলেন, নারী ও শিশুর জন্য নগর সেবা নিশ্চিত করার জন্য আগে সবার দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো জরুরি। বৈষম্যের মূল কারণ হচ্ছে, নারীর অধিকার ও সমতাকে খাটো করে দেখা হয়। উন্মুক্ত স্থানগুলোতে পার্ক বানানো হলেও সেখানে কিশোরীদের, নারীদের যেতে উৎসাহ দিতে হবে।