নারীর জন্য চাই নিরাপদ নগর

প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দিচ্ছেন গাজীপুরের মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম। বাঁ পাশে জ্যেষ্ঠ সচিব শামসুল আলম, হোসেন জিল্লুর রহমান, ডানে নজরুল ইসলাম। গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সিএ ভবনে।  ছবি: প্রথম আলো
প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য দিচ্ছেন গাজীপুরের মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম। বাঁ পাশে জ্যেষ্ঠ সচিব শামসুল আলম, হোসেন জিল্লুর রহমান, ডানে নজরুল ইসলাম। গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারের সিএ ভবনে। ছবি: প্রথম আলো

শুধু উঁচু উঁচু ভবন তৈরি করলেই নগরায়ণ হয় না। উন্নত ও বাসযোগ্য নগর গড়ে তুলতে নারী ও শিশুর জন্য নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করা জরুরি। বাসস্থান, কর্মস্থল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও চলাফেরা—এই চার ক্ষেত্রে নারী ও শিশুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। আবার নারীরা সমস্যায় পড়লে অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিকার পায় না।

‘নারী ও শিশুবান্ধব নগর সেবা এবং সুশাসন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্টজনদের আলোচনায় এসব বক্তব্য উঠে এসেছে। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে গতকাল রোববার সকালে এই বৈঠক হয়। জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) ও পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সহযোগিতায় এই বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো। বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।

বৈঠকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, নগরে এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যেখানে মা ও শিশু নিরাপদ এবং সুস্থ পরিবেশে বেড়ে ওঠে। নারী ও শিশুরা যদি সম্মানের সঙ্গে নগরে থাকতে না পারে, তাহলে সমাজ স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে না।

পাড়া-মহল্লায় বিউটি পারলার গড়ে উঠলেও শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত ডে-কেয়ার সেন্টার নগরগুলোতে নেই বলে বৈঠকে উল্লেখ করেন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ও জ্যেষ্ঠ সচিব শামসুল আলম। তিনি বলেন, নগরীতে নারী ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা, বিনোদন, খোলা মাঠের ব্যবস্থা থাকা—এগুলোই মানুষের চাওয়া। উদ্যোক্তাদের জন্য সরকার ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে। যারা ডে-কেয়ার সেন্টার খুলবে, সরকার তাদের সহযোগিতা দেবে।

সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম বলেন, অহরহ নারী ধর্ষণ, খুনের ঘটনা শোনা যায়। নগরীতে যেকোনো উন্নয়ন করা হলে তার কেন্দ্রে যেন মানুষ থাকে, মানুষ যেন উপকারভোগী হয়, সেটা দেখতে হবে। সুশাসন ও সেবার ঘাটতি থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সমাজব্যবস্থায় ধনীরা এত বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে মধ্যবিত্তদের কথা পাত্তা পাচ্ছে না।

প্রতিকার মেলে না

নারী ও শিশুরা সমস্যায় পড়লে প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ থাকা জরুরি বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান। কিন্তু নারী ও শিশুরা সমস্যায় পড়লে প্রতিকার না পাওয়ার অভিযোগই বেশি। নিরাপদ নগর গড়তে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, সুশাসন নিশ্চিত করা শুধু সরকারের একার দায়িত্ব নয়, নাগরিকদেরও আচরণের ক্ষেত্রে দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে হবে।

ইউনিসেফের সামাজিক নীতি বিশেষজ্ঞ হাসিনা বেগম বলেন, নগরে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের ফাঁক আছে, পরিকল্পনায় ঘাটতি আছে। ভালো সেবা দিতে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তথ্য ও সেবার ঘাটতি আছে। তিনি বলেন, অনেক পোশাক কারখানায় ডে-কেয়ার হয়েছে। তবে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ডে-কেয়ার সেন্টার অপর্যাপ্ত। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতগুলোতে ডে-কেয়ার সেন্টার বাড়াতে হবে। সিটি করপোরেশন এ ক্ষেত্রে কাজ করতে পারে।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক সারওয়ার জাহান বলেন, নগরীতে শিশুরা কীভাবে বেড়ে উঠছে, সেখানে নজর দিতে হবে। একই সঙ্গে সবাই যাতে সমান সুযোগ পায়, সেটিও বিবেচনায় নিতে হবে।

ফ্ল্যাট কেনার মাধ্যমে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলেও নগরগুলোতে উন্মুক্ত স্থান গড়ার লক্ষ্যে কেন সুযোগ তৈরি করা হলো না, সে প্রশ্ন তোলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ইশরাত ইসলাম। তিনি বলেন, ঢাকার অনেক মাঠের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। অথচ এলাকাভিত্তিক ছোট জায়গাগুলো একটু বিনিয়োগ ও সংস্কার করে ব্যবহারের উপযোগী করা যায়।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সিনিয়র সহকারী প্রধান মো. মাহবুবুল আলম সিদ্দিকী বলেন, ২০২৯ সাল নাগাদ দেশের নগরগুলোর জনসংখ্যা আট কোটি ছাড়িয়ে যাবে। এই জনগোষ্ঠীর সেবা নিশ্চিতে এখন থেকেই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোকে।

ছাদ থেকে দেখা যায় ‘বৈষম্য’

নগর-পরিকল্পনায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত নারী ও শিশুদের কথা ভাবা হয় কি না, বৈঠকে সে প্রশ্ন তোলেন যুক্তরাজ্যের উন্নয়ন সংস্থা ডিএফআইডির সামাজিক উন্নয়ন উপদেষ্টা আনোয়ারুল হক।

ইউএনডিপির দারিদ্র্য এবং নগরায়ণ বিভাগের প্রধান আশেকুর রহমান বলেন, নগরগুলোতে যে শ্রেণিবৈষম্য ও বিভক্তি আছে, তা বহুতল ভবনের ছাদে উঠলেই বোঝা যায়। উঁচু ভবনগুলোর পাশেই হাজার হাজার বস্তিঘর চোখে পড়ে। এসব বস্তিবাসীর সংখ্যা কত, সে পরিসংখ্যানেরও অভাব আছে। ঢাকার গণপরিবহন নারীবান্ধব নয় বলেও উল্লেখ করে তিনি।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) নারী ও শিশুর উন্মুক্ত স্থানে হাঁটাচলা, খেলাধুলা, সময় কাটানোর নির্দিষ্ট একটি লক্ষ্য নির্ধারিত আছে বলে জানান ইউএন হ্যাবিট্যাটের নগর-পরিকল্পনা ও নকশা বিভাগের জ্যেষ্ঠ কর্মসূচি সমন্বয়ক মো. সোহেল রানা। কিন্তু উন্মুক্ত স্থানগুলোতে ব্যক্তিস্বার্থেই ইমারত নির্মাণ করা হচ্ছে।

নারী ও শিশুর জন্য নগর সেবা নিশ্চিত করতে সবার আগে দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো জরুরি বলে মনে করেন বেসরকারি সংস্থা পিপিআরসির গবেষণা সহযোগী উমামা জিল্লুর। তিনি বলেন, নারীর অধিকার ও সমতাকে খাটো করে দেখা হয়। উন্মুক্ত স্থানগুলোতে পার্ক বানানো হলেও নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি সেখানে কিশোরী ও নারীদের যেতে উৎসাহ দিতে হবে।