১০৩ টাকায় সরকারি চাকরি

মিনারা আক্তার। বাবা দিনমজুর। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। অভাবের সংসার। নিজে টিউশনি করে বহু কষ্টে এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। সংসারের হাল ধরতে পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরির জন্য ১০০ টাকার ব্যাংক ড্রাফট ও ৩ টাকায় ফরম কিনে আবেদন করেন। চূড়ান্ত ফলাফলে মিনারার নাম ঘোষণা করতেই মুহূর্তের মধ্যে পরিবেশটা আবেগঘন হয়ে ওঠে। তিনি দৌড়ে গিয়ে পুলিশ সুপারের পা ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এই দৃশ্য দেখে উপস্থিত সবাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। মিনারা জেলার ইসলামপুর উপজেলার পূর্ব বাহাদুরপুর গ্রামের কৃষক মনোয়ার হোসেনের মেয়ে।

গত শনিবার রাত আটটার দিকে জামালপুর শহরের বেলটিয়া এলাকার পুলিশ লাইনস মাঠে কনস্টেবল পদে চাকরির চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করা হয়। চূড়ান্ত ফলাফলে উত্তীর্ণ বেশির ভাগ প্রার্থীই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। পুলিশের ‘ইমেজ ক্রাইসিস’ থেকে রক্ষা পেতেই ঘুষ ও তদবির ছাড়াই সততা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে জামালপুরে ৭১ জনকে কনস্টেবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা মাত্র ১০০ টাকার ব্যাংক ড্রাফট ও ৩ টাকার ফরমের খরচে এ চাকরি পেয়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগই দরিদ্র পরিবারের সন্তান।

পুলিশ সুপারের কার্যালয় সূত্র জানায়, কনস্টেবল পদে ৭১ জনের বিপরীতে ২ হাজার প্রার্থী আবেদন করেন। ১ জুলাই তাঁদের মধ্য থেকে শারীরিক যোগ্যতা ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের ভিত্তিতে ৫২২ জনকে লিখিত পরীক্ষার জন্য চূড়ান্ত করা হয়। ২ জুলাই লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ৫ জুলাই লিখিত পরীক্ষার ফলাফলে ১৮৫ জন উত্তীর্ণ হন এবং ওই দিনই মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। শনিবার রাত আটটার দিকে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে চূড়ান্তভাবে ৭১ জনের নাম ঘোষণা করা হয়। কনস্টেবল পদে চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার মধ্যে কৃষক পরিবারের ৫৩ জন, চাকরিজীবী পরিবারের ৭ জন ও অসহায় এতিম পরিবারের ১২ জন রয়েছেন।

ফলাফল ঘোষণার পর মিনারার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তিনি বলেন, তাঁদের পাঁচ সদস্যের পরিবার। দুই বোন ও এক ভাই। তিনিই সবার বড়। খেয়ে না-খেয়ে কোনো রকমে তাঁদের দিন চলে। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে তাঁর লেখাপড়া চালাতেন। পরে তিনি টিউশনি করে লেখাপড়ার খরচ জোগাতেন। তবে অভাব তাঁদের পিছু ছাড়ছিল না।

মিনারা বলেন, পুলিশের কনস্টেবল পদে ঘুষ ছাড়াই চাকরি হবে—বিভিন্ন জায়গায় এমনটা শুনে তিনি আবেদন করেছিলেন। তিনি নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যে কোনো রকম টাকা ছাড়াই মাত্র ১০৩ টাকা খরচে চাকরি পাওয়া যায়। এবার মেধা ও যোগ্যতার মূল্যায়ন হয়েছে। তাই নাম ঘোষণার সময় আবেগে কান্নাটা ধরে রাখতে পারেননি। এভাবে চাকরি দেওয়ায় পুলিশ সুপারকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

মিনারার মতো অসহায় দরিদ্র পরিবারের হাসবুন নাহার, আফরোজা, মিথিলা মীর, মো. আলামিন, মো. রাসেল মিয়া, রিপন মাহমুদসহ সবাই ১০৩ টাকা খরচে চাকরি পেয়েছেন বলে তাঁদের দাবি।

চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হওয়া দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার আকন্দপাড়া গ্রামের রিপন মাহমুদের বাবা একজন কৃষক। অন্যের জমি চাষ করেই কোনো রকমে সংসার চালান। রিপন বলেন, ‘চাকরির জন্য ঘুষ দেওয়ার মতো সামর্থ্য আমাদের নেই। আবেদনের আগে থেকেই বিভিন্ন জায়গায় শুনছিলাম এবার ঘুষ ছাড়াই চাকরি হবে। সত্যিই এটা বাস্তব হলো। মাত্র ১০৩ টাকা খরচে চাকরিটা পেলাম।’

ফলাফল ঘোষণার পর পুলিশ সুপার মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, পুলিশের ইমেজ ক্রাইসিস নিয়ে অনেক কিছুই পত্রপত্রিকায় আসে। এই ইমেজ ক্রাইসিস থেকে রক্ষা পেতেই সততার সঙ্গে কোনো প্রকার ঘুষ-তদবির ছাড়াই মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ পরীক্ষা সম্পন্ন করা হয়েছে। জনগণ যেন বলে পুলিশ দেশ ও জনগণের সেবক। তিনি বলেন, ‘আমি ২০০৩ সাল থেকে কনস্টেবল নিয়োগ পরীক্ষার সঙ্গে জড়িত। এবারের মতো শতভাগ স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতার মাধ্যমে মেধাভিত্তিক নিয়োগ আগে কখনো দেখিনি। বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম প্রতিরোধে নিয়োগ পরীক্ষার আগে থেকে আমরা সতর্ক ছিলাম। দালালেরা যাতে প্রার্থীদের প্রতারিত করতে না পারে, সে জন্য গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক দল মাঠে কাজ করেছে।’

পুলিশ সুপার বলেন, জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদ কেউ বলেননি যে তাঁর লোকটাকে চাকরি দিতে হবে। তাঁকে অনেকেই ফোন করেছেন। তিনি তাঁদের বলছেন এবারের নিয়োগ মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতেই হবে। তিনি তাই-ই করেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই নিয়োগের ওপর নজরদারি করেছেন।