বগুড়ার সেই সাজ্জাদ এখনো অধরা

বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার পালপাড়া পোড়ানো সন্ত্রাসীদের আশ্রয়দাতা সাজ্জাদ হোসেনের বিরুদ্ধে এবার আওয়ামী লীগের স্থানীয় এক নেতা হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে মামলা করেছেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে তদন্তভার পিবিআইয়ের (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) ওপর ন্যস্ত করেছেন।

তবে বাদীর অভিযোগ, থানা-পুলিশের সঙ্গে সখ্য থাকায় সাজ্জাদ নানা অপকর্ম করেও এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।

শাজাহানপুর উপজেলার কাটাবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা সাজ্জাদ হোসেনের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের নির্যাতনসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে মদদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

গত ১৯ জুন বগুড়ার জ্যোষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে করা মামলায় আতাউর রহমান অভিযোগ করেন, তিনি উপজেলার খোদাবন্দবালা চারমাথা সোনালি বাজারে কাঠের ব্যবসা করেন। ১২ জুন রাতে সদলবলে বাজারে গিয়ে সাজ্জাদ এবং তাঁর সহযোগীরা বাদী আতাউরের কাছে বঙ্গবন্ধু পরিষদের উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইনছান আলীর খোঁজ করেন। খোঁজ দিতে অস্বীকৃতি জানালে সাজ্জাদ ও তাঁর সহযোগীরা ধারালো অস্ত্র ও রড দিয়ে তাঁকে রক্তাক্ত জঘম করেন। একপর্যায়ে পিস্তল বের করে ফাঁকা গুলি ছুড়ে হত্যার হুমকি দিয়ে তাঁরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন। পরে বাজারের লোকজন আতাউরকে উদ্ধার করে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন।

আতাউর রহমান আরও অভিযোগ করেন, মারধর ও হত্যাচেষ্টার ঘটনায় সাজ্জাদ ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে শাজাহানপুর থানায় মামলা দিতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। বাধ্য হয়ে তিনি আদালতে মামলা দেন।

জানতে চাইলে শাজাহানপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, থানায় মামলা দিতে এসে কেউ ফিরে গেছেন এমন দাবি ভিত্তিহীন। তিন মাস আগে থানায় তিনি যোগদান করেছেন, সাজ্জাদ নামের কারও সঙ্গে এই থানা–পুলিশের ওঠাবসা থাকলে তা তাঁর (ওসি) নজরে পড়ত।

পিবিআইয়ের বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরিফ উদ্দিন বলেন, ‘আদালত থেকে এ রকম কোনো মামলার নথি এখনো হাতে পাইনি। নথি পেলে যথাযথ তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন পাঠানো হবে।’

উপজেলা প্রশাসন ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে উপজেলার আড়িয়া পালপাড়ায় শতাধিক সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। সাজ্জাদের খালাতো ভাই মোরশেদ আলম ওই সময় কলেজপড়ুয়া সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক তরুণীকে অপহরণ করে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করেন। পরে মেয়েটিকে পুলিশ উদ্ধার করে। তবে সাজ্জাদের তদবিরে মোরশেদ পার পেয়ে যান। নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা পরিবারটি পরে দেশ ছেড়ে সপরিবারে ভারতে পালিয়ে যায়।

হত্যা ও চাঁদাবাজির একাধিক মামলার আসামি মোরশেদ মাদক ব্যবসা, জবরদখল, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারীদের ওপর নির্যাতন, বসতবাড়ি ও মৃৎশিল্পে হামলা, প্রতিমা ভাঙচুরসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকলেও আশ্রয়দাতা খালাতো ভাই সাজ্জাদের কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন তিনি।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে (এসপি) স্বারকলিপি দিয়ে প্রতিকার চেয়ে ব্যর্থ হন। পরে মোরশেদ বাহিনীর অত্যাচারে পালপাড়ার নারীদের নিরাপত্তায় রাত জেগে গ্রাম পাহারা দেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন। এ নিয়ে ২০১৫ সালের ১৬ মে প্রথম আলোয় ‘পালপাড়া পোড়াচ্ছে এক সন্ত্রাসী’ শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপা হলে দেশজুড়ে তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়। রাতারাতি মোরশেদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সংখ্যালংঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের বিষয়টি তদন্ত করে আইন শালিস কেন্দ্র। সরকারের ওপর মহলের নির্দেশে জেলা প্রশাসন পালপাড়া পোড়ানোর ঘটনা তদন্ত করতে কমিটি গঠন করে। ২০১৫ সালের ১ নভেম্বর শাজাহানপুর উপজেলার তৎকালীন ইউএনও গণশুনানির ভিত্তিতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন সরকারের উচ্চমহলে। চার পৃষ্ঠার ওই তদন্ত প্রতিবেদনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনে জড়িত সন্ত্রাসী মোরশেদের গডফাদার বা আশ্রয়দাতা হিসেবে খালাত ভাই সাজ্জাদ হোসেনের নাম উল্লেখ করা হয়। তবে তদন্ত প্রতিবেদনে নাম এলেও পুলিশের সঙ্গে সখ্যতা থাকার কারণে ওই ঘটনায় ধরাছোয়ার বাইরে থেকে যান সাজ্জাদ। পরে সাজ্জাদের তদবিরেই মোরশেদ সংখ্যালঘু নির্যাতনের মামলায় পাড় পেয়ে যায়।

আওয়ামী লীগের নেতা আতাউর রহমানের ওপর হামলার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সাজ্জাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আতাউর রহমানের সঙ্গে তাঁর কোনো বিরোধ নেই। তাঁকে তিনি মারধর কিংবা হুমকিও দেননি। গুলি ছোঁড়ার বিষয়টিও কাল্পনিক।

সাজ্জাদ হোসেন আরও বলেন,‘ যে কেউ যে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করতেই পারে। প্রমাণ করুক।’ তিনি দাবি করে বলেন, ‘পালপাড়ার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কেউ কেউ গণশুনীতে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও পরে ভুল স্বীকার করেছেন। পালপাড়ার অনেককে অর্থকড়ি দিয়ে সহযোগীতা করি। এখন কেউ আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করার মতো নেই।’

তবে গত বুধবার পালাপাড়ার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একাধিক সদস্য বলেন, সাজ্জাদের আশ্রয়-প্রশয়ে সন্ত্রাসী মোরশেদ দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে পালপাড়ার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পরিবারকে জ্বালিয়েপুড়িয়ে ছারখার করেছেন। ওই সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেক লোকজন সাহস করে গণশুনানিতে তদন্ত কমিটির কাছে মোরশেদ ও সাজ্জাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। কিন্ত কোনো প্রতিকার পাননি। সাজ্জাদের তদবিরে মোরশেদ অল্প দিনের মাথায় জামিনে ছাড়া পেয়ে এলাকায় ফেরেন। সাজ্জাদের দাপটে এখন এলাকাবাসী অসহায়। আড়িয়া এলাকায় যত অপকর্ম হয়, তার সঙ্গে সাজ্জাদ এবং তাঁর লোকজন জড়িত। ক্যাডার নিয়ে চলাফেরা করেন তিনি। ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতার আর্শীবাদও রয়েছে তাঁর ওপর।