ধান ক্রয়ে ধীরগতি, ক্ষুব্ধ কৃষক

দেশের অন্যতম বোরো ধান উৎপাদনকারী জেলা নওগাঁয় সরকারিভাবে গত ১৫ মে থেকে শুরু হওয়া বোরো ধান সংগ্রহ অভিযান চলছে ধীরগতিতে। গত দুই মাসে নওগাঁ খাদ্য বিভাগ ধান কিনেছে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩২ শতাংশ। কৃষকেরা বলছেন, যেভাবে ধান কেনা হচ্ছে, তাতে তাঁদের কোনো উপকার হচ্ছে না। শুরুতে দর সামান্য বাড়লেও তা স্থায়ী হয়নি। গত এক সপ্তাহে দাম আরও কমেছে।

খাদ্য বিভাগের দাবি, তালিকা সংগ্রহে সমস্যা, কৃষকদের ব্যাংক হিসাব ও গুদামে পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় ধান কেনার কার্যক্রম গতি পাচ্ছে না। এ অবস্থায় সরকারের ধান কেনার প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন ও খাদ্য মজুতের স্থান বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন কৃষক নেতারা।

জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় থেকে জানা গেছে, ১৫ মে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার নওগাঁয় ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানের উদ্বোধন করেন। প্রথম দফায় ৫ হাজার ৬৩২ মেট্রিক টন ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। পরে আরও ৯ হাজার ৩৮৭ মেট্রিক টন ধান কেনার বরাদ্দ পাওয়া যায়। অর্থাৎ জেলায় মোট ধান কেনার লক্ষ্যমাত্রা ১৫ হাজার ১৯ মেট্রিক টন। গতকাল সোমবার পর্যন্ত কেনা হয়েছে মাত্র ৪ হাজার ৯৫৪ মেট্রিক টন, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৩২ শতাংশ। আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সংগ্রহ অভিযান চলবে। জেলায় বোরো চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৬৪ হাজার ৪৮০ মেট্রিক টন।

জেলার ১৯টি খাদ্যগুদামে ধান-চাল মজুতের ধারণক্ষমতা হচ্ছে ৩৯ হাজার ২৫০ মেট্রিক টন। অথচ এবার বোরো ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭২ হাজার ৪৮০ মেট্রিক টন। অর্থাৎ গুদামের ধারণক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

নিয়ামতপুর উপজেলার ছাতড়া বাজারে প্রতিদিন ধান কেনা-বেচা হয়। গতকাল সকালে ওই বাজারের ক্রেতা–বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জিরা ধান বিক্রি হচ্ছে মণপ্রতি ৬৭০ থেকে ৬৮০ টাকায়। কাটারিভোগ বিক্রি হচ্ছে ৮৮০ থেকে ৯০০ টাকায়। আড়তদার ও কৃষকেরা জানান, এক সপ্তাহ ধরে ধানের দাম কমছে। এক সপ্তাহ আগে জিরা ধানের দাম ছিল ৭৩০ টাকা এবং কাটারিভোগ ধানের দাম ছিল ৯২০ টাকা।

ধান বিক্রি করতে আসা অন্তত ১৫ জন কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশি দামে কেনা হলেও অধিকাংশ কৃষকই সরকারি গুদামে ধান দিতে আগ্রহী নন। কারণ, উৎপাদনের তুলনায় সরকারিভাবে কেনার লক্ষ্যমাত্রা অনেক কম। তা ছাড়া উপজেলা সদরে গুদামে ধান নিতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। পাশাপাশি ধান দেওয়ার সময় আর্দ্রতার বিষয়ে কড়াকড়ি, ধান কেনার প্রক্রিয়া সহজ না হওয়ায়, অনেকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকাসহ নানা কারণে সরকারি গুদামে ধান দিতে আগ্রহী নন কৃষকেরা।

নিয়ামতপুর উপজেলার বুধুরিয়া গ্রামের কৃষক আবদুস সালাম বলেন, ‘২৫ বিঘা জমিতে বোরো ধানের আবাদ করেছিলাম। উৎপাদনে ব্যয় হয়েছে প্রায় দেড় লাখ টাকা। বিনিময়ে ধান পেয়েছি প্রায় ৪০০ মণ। অথচ গুদামে ধান দিতে পারব মাত্র ২৫ মণ। এই পরিমাণ ধান ৩০ কিলোমিটার দূরে উপজেলা সদরের গুদামে নিতে হবে। এ ছাড়া গুদামে নেওয়ার পর আর্দ্রতার ঝামেলার কথা বলে ধান না নিলে তা আবার বাড়িতে ফেরত আনতে হবে। এসব নানা ঝামেলার কথা চিন্তা করে টাকা বেশি পেলেও গুদামে ধান দিতে কোনো আগ্রহ পাচ্ছি না। দাম কম হলেও ঝামেলা এড়াতে বাজারেই ধান বিক্রি করছি।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় প্রায় ৬৬ হাজার কৃষক বোরো মৌসুমে গড়ে ১২ লাখ টন ধান উৎপাদন করে। এই হিসাবে সরকার যদি প্রত্যেক কৃষকের কাছ থেকে ১ টন করেও ধান কেনে, তাহলে ১৫ হাজার ১৯ জন কৃষক সরকারি গুদামে ধান দিতে পারবেন। অর্থাৎ মাত্র ২২ শতাংশ কৃষক সরকারি গুদামে ধান সরবরাহ করতে পারবেন।

স্থানীয় সংগঠন সমাজতান্ত্রিক কৃষক স্বার্থ রক্ষা কমিটির সভাপতি জয়নাল আবেদিন বলেন, দেশের ৮০ শতাংশ কৃষকই নিম্ন আয়ের। ধান ওঠার এক-দেড় মাসের মধ্যেই তাঁরা ধান বিক্রি করে ফেলেন। এ অবস্থায় তিন-চার মাস ধরে ধীরগতিতে ধান কিনলে প্রান্তিক কৃষকের কোনোই লাভ হবে না। এ জন্য শুরুতেই ক্রয়কেন্দ্র খুলে দ্রুত কৃষকদের ধান কিনতে হবে।

ভারপ্রাপ্ত জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাজের হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অভিযানের শুরুতে কৃষকদের তালিকা পেতে দেরি হয়েছে। এ ছাড়া গুদামগুলোতে জায়গার অভাব রয়েছে। প্রথম দফার বরাদ্দের প্রায় পুরোটা কেনা হয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি উপজেলায় দ্বিতীয় দফার বরাদ্দের ধান কেনার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গুদামে ধান দিতে কৃষকদের অনাগ্রহের বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারি গুদামে ধান দিতে বিড়ম্বনা হয়, এমন ধারণা ভুল। মন্ত্রীর নির্দেশে এবার সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থেকে ধান প্রকৃত কৃষকদের কাছ থেকে কেনা হচ্ছে। কেউ প্রকৃত কৃষক হলে অবশ্যই তাঁর কাছ থেকে ধান কেনা হবে। কোনো বিড়ম্বনায় তিনি পড়বেন না।