দ্রুত বিচার আইন নিয়ে আ.লীগ-বিএনপির পাল্টাপাল্টি

২০০২ সালে দ্রুত বিচার আইন করেছিল বিএনপি-জোট সরকার। তখন এই আইনের সমালোচনা করেছিল তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। আজ মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে ষষ্ঠ দফায় আইনটির মেয়াদ আরও ৫ বছর বাড়াল আওয়ামী লীগ সরকার। এবার সংসদে এই আইনের প্রয়োজনীয়তা ও প্রয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলে এর বিরোধিতা করল বিএনপি।

আওয়ামী লীগ বিএনপির পাল্টাপাল্টি বিরোধিতার মধ্য দিয়ে আজ বহুল আলোচিত ‘আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুতবিচার) (সংশোধন) বিল- ২০১৯’ পাস হয়। এতে আইনটির মেয়াদ আরও ৫ বছর বাড়ানো হয়। আইনটি ২০২৪ সাল পর্যন্ত চলবে।

আজ বিল পাসের আগে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি একে অন্যের বিরুদ্ধে এই আইনের অপপ্রয়োগের অভিযোগ আনে। আর জাতীয় পার্টি বলেছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুই পক্ষই যে কালো আইন করেছে, তার প্রমাণ তারা সংসদে দিয়ে গেল।

বিলটির ওপর জনমত যাচাই ও বাছাই কমিটিতে পাঠানোর প্রস্তাব দিয়ে বিএনপির সাংসদ হারুনুর রশীদ বলেন, এই বিলটিকে নিপীড়নকারী বিল হিসেবে উপস্থাপন করা প্রয়োজন ছিল। বিলের উদ্দেশ্য ও কারণ–সংবলিত বিবৃতিতে যেসব অপরাধ দমনের কথা বলা হয়েছে, এসব কাজের সঙ্গে সরকারি দলের লোকজন জড়িত। কিন্তু চাঁদাবাজি, ছিনতাইয়ের মতো এসব অপরাধে এই আইন সরকারি দলের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে প্রয়োগ হয়েছে, তার প্রমাণ নেই। এই আইনে শুধু বিএনপির নেতা-কর্মীদের নামে মিথ্যা, ভুয়া মামলা দেওয়া হয়েছে। সম্পাদক মইনুল হোসেন, মাহমুদুর রহমান আইনের আওতায় থাকা অবস্থায় তাঁদের ওপর নির্মম হামলা করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে এ আইন প্রয়োগ হয়নি।

বিএনপির সংরক্ষিত নারী আসনের সাংসদ রুমিন ফারহানা বলেন, ২০০২ সালে এই আইনটি সম্পর্কে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী (শেখ হাসিনা) বলেছিলেন, দ্রুত বিচার আইন করা হচ্ছে বিরোধী দলের সদস্যদের শাস্তি দেওয়ার জন্য। সরকারি দলের সদস্যদের ছেড়ে দেওয়া হবে। রুমিন বলেন, গত ১০ বছরে সেটাই দেখা গেছে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের নানা রকম হয়রানি করা হয়েছে, মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। সরকার এই আইনে এতই মজা পেয়েছে যে, আবার মেয়াদ বাড়াচ্ছে। কিন্তু আইনটিকে স্থায়ী না করে ঠিক নিজের মেয়াদকাল পর্যন্ত এই আইনের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। যাতে বিরোধী দলের ওপর নিপীড়ন–নির্যাতন চালানো যায়। এই আইনে বিরোধী দলকে হয়রানি করার অসংখ্য সুযোগ রয়েছে। রুমিন বলেন, এই আইনের কোনো প্রয়োজন আছে কি না, সে বিষয়ে জনমত জরিপ দরকার। তা ছাড়া আইনে যে সময়ে বিচার করার কথা বলা আছে, তাতে ন্যায়বিচার পাওয়ার শঙ্কাও আছে।

বিএনপির আরেক সাংসদ মোশাররফ হোসেন বলেন, বিএনপিকে দ্রুততম সময়ে নাজেহাল করার জন্য এই আইনের মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। খুন–ধর্ষণের দিকে নজর না দিয়ে শুধু বিএনপিকে নাজেহাল, মামলা-হামলার দিকে নজর দিচ্ছে সরকার। মনে হয়, যদি বিএনপির কোনো কর্মী সাগরের তলদেশে থাকে সেখান থেকেও নিয়ে আসা সম্ভব।

গণফোরামের মোকাব্বির খান বলেন, দেশ ও জাতির কল্যাণের চেয়ে এই আইনের অপপ্রয়োগ বেশি হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা বিরোধীদের ঘায়েল করতে এই আইন প্রয়োগ করছে। ২০০২ সালে বিএনপি–জোট এই আইন করেছিল। সেদিন আওয়ামী লীগ বলেছিল, এটি কালো আইন, আওয়ামী লীগ দমনের আইন। এখন তাদের ভিন্ন সুর।
বিএনপির সাংসদদের বক্তব্যের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ২০০২ সালে বিএনপির আমলে এই আইন হয়েছিল। তখন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নামে শত শত মামলা হয়েছিল। বিএনপির নেতা-কর্মীরা লুটপাট করে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নামে মামলা দিয়েছিল।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেন, বিএনপির নেতা-কর্মীদের নামে দ্রুত বিচার আইনে কোনো মামলা করা হয়নি। অগ্নিসন্ত্রাস, গাড়ি ভাঙচুরের কারণে সম্পদ ধ্বংসের মামলা হয়েছে।

বিএনপির উদ্দেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘জিজ্ঞাসা করতে চাই, এই আইনে তাদের নামে কয়টা মামলা হয়েছে?’ আসাদুজ্জামান খান বলেন, ২০০৭ সালে তারেক রহমানের নামে এই আইনে মামলা হয়েছিল। কিন্তু ৭ দিনের হেরফেরে তিনি রক্ষা পেয়ে গিয়েছিলেন। এই আইনের সুবিধা পেয়ে থাকলে বিএনপিই পেয়েছে।

আজ জাতীয় পার্টির সাংসদ ফখরুল ইমাম বলেন, ২০০২ সালের পর সব সরকারই এই আইন ব্যবহার করেছে। কেউ বাতিল করেনি। ছয়বারে ১৭ বছর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
বিএনপি–জোট সরকারের আমলে ২০০২ সালে দ্রুত বিচার আইন সংসদে পাস হয়। ওই সময় এই আইনের মেয়াদ ছিল ২ বছর। আইনটি পাসের পর সে সময়ের বিরোধী দল আওয়ামী লীগ ব্যাপক সমালোচনা করেছিল। তবে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগও এই আইনটির মেয়াদ দফায় দফায় বাড়িয়েছে। মোট ৬ দফায় এই আইনের মেয়াদ বাড়ানো হয়। সর্বশেষ ২০১৪ সালে এই আইনের মেয়াদ ৫ বছর বাড়ানো হয়। গত ৯ এপ্রিল আইনটির মেয়াদ শেষ হয়। এই অবস্থায় আইনটির মেয়াদ আবার ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হলো।

আইনটি প্রণয়নের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছিল, চাঁদাবাজি, যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি, যানবাহনের ক্ষতি সাধন, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিনষ্ট, ছিনতাই, দস্যুতা, ত্রাস ও সন্ত্রাস সৃষ্টি, অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি, দরপত্র কেনায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ বিভিন্ন অপরাধ দ্রুততার সঙ্গে বিচারের জন্য এ আইন।

এ আইনে দোষী প্রমাণিত হলে দুই থেকে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড হতে পারে। প্রতি জেলায় গঠিত এক বা একাধিক দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে এ আইনের মামলার বিচার চলে।
দ্রুত বিচার আইনে ১২০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ নিষ্পত্তি করার বিধান আছে। এই সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করা না গেলে আরও ৬০ দিন সময় পাওয়া যায়।