আমাদের আত্মার গুরুতর অসুখ

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

প্রতিদিন খবরের কাগজ আর টেলিভিশনের পর্দাজুড়ে থাকে ধর্ষণের খবর, যা আমাদের জানায়, আমাদের আত্মায় বাসা বেঁধেছে এক গুরুতর অসুখ। ধর্ষণের শিকার বৃদ্ধা থেকে শিশু, মেয়ে এবং ছেলে, যাদের বয়স দুই থেকে নিয়ে আশি। নানা সংস্থার, গণমাধ্যমের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ধর্ষণের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, যেমন বাড়ে নিরাময়-অযোগ্য অসুখের প্রকোপ।

পরিসংখ্যানে অবশ্য ভাসমান হিমশৈলীর চূড়াটাই শুধু দেখা যায়, আরও যে অসংখ্য ঘটনা জানাজানির, আইন-আদালতের জ্ঞানের বাইরে থেকে যায়, সেসব আমাদের আন্দাজ করে নিতে হয়। ধর্ষকদের তালিকায় এখন আর শুধু বখাটে বা মাদকাসক্তরাই নেই, আছে কেতাদুরস্ত পরিবারের, ক্ষমতাশালীদের সন্তানেরাও। শিশু ধর্ষকদের তালিকায় এখন নাম লিখিয়েছেন স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষকেরা এবং অত্যাশ্চর্যভাবে, মসজিদের ইমাম। হয়তো এঁরা বরাবরই ছিলেন। এখন যে প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাঁরা শিশুদের ধর্ষণ করছেন, সেই প্রযুক্তি আবার তাঁদের গণমাধ্যমের আলোয় নিয়ে আসছেন। ধর্ষকেরা বিপন্ন শিশুদের ছবি তুলে রাখে, সেগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে তাদের নিশ্চুপ রাখে। আর এসব ঘটনা যখন আমাদের গোচরে আসে, আমরা বিচলিত হই, হইচই ওঠে। কিছু ধর্ষক ধরা পড়ে, কিছু মরে বন্দুকযুদ্ধে। তারপর সেসব চাপা পড়ে যায় তাজা কোনো চাঞ্চল্যকর খবরের নিচে।

শরীরের অসুখ থেকে আরোগ্য পাওয়া যায়, মনের অসুখেরও চিকিৎসা আছে, কিন্তু আত্মার অসুখের? এই অসুখ নিরাময় করতে পারে নৈতিকতা, সুনীতি চর্চা, শুদ্ধাচার এবং নান্দনিক বোধের বিস্তার। কিন্তু যেসব উৎস থেকে সেগুলোর উৎসার এবং বিকাশ, সেগুলো আমরা রুদ্ধ করে দিয়েছি। আমরা বলি বটে, সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে, কিন্তু এটি তো বক্তৃতার কথা, হাঁটু-ঝাঁকানো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার কথা। শুদ্ধতার উৎসগুলো পাথরচাপা থাকলে সচেতনতা কীভাবে বাড়বে?

শুধু এই একটি কারণে শিশু ধর্ষণ বাড়ছে, তা নয়, কারণ অসংখ্য। একটি প্রধান কারণ আমাদের অকার্যকর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির। অন্য একটি অপরাধীদের ক্রমাগত বেপরোয়া হয়ে ওঠা। কারণ তারা জানে, যত গুরুতর হবে অপরাধ, তত তাদের সুরক্ষা দিতে এগিয়ে আসবেন শক্তিশালীরা। গত ১০ বছরে গণমাধ্যমে আসা কতগুলো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল, কত অপরাধী ধরা পড়েছিল, কয়জনের বিচার সমাপ্ত হয়েছে, কয়জন শাস্তি পেয়েছে—এই পরিসংখ্যানগুলোর দিকে চোখ বোলালে হতাশ হতে হয়। আমরা প্রায়ই ‘দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির’ দাবি তুলি। সেই শাস্তি দূরের কথা, আইনানুগ শাস্তিই–বা কয়জন পায়। ধর্ষক জামিন পায়, আবারও ধর্ষণ করে। সোনাগাজীর কথা ভাবুন। নির্যাতক শিক্ষককে বাঁচাতে পুলিশ-প্রশাসন থেকে স্থানীয় রাজনীতিবিদেরা নেমে পড়লেন। ওই বিচার চলছে, কিন্তু আরও কত অসহায় শিশু বিচারবঞ্চিতদের তালিকায় থেকে যাবে, তা নিয়ে আমরা কি ভাবি? 

প্রযুক্তির ভালো–মন্দ আছে। আমরা মন্দটা বেশি নিচ্ছি। স্মার্টফোন এখন ছোট ছোট ছেলেমেয়ের হাতে। ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহার করে আমরা জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে পারতাম, কিন্তু সেই সংযোগ এখন পর্নোগ্রাফিকে সহজপ্রাপ্য করেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মাদক—ইয়াবা। বাংলাদেশই বোধ হয় পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেখানে সমাজের এক বিশাল ক্ষমতাশীল অংশ সন্তানদের হাতে মাদক তুলে দিয়ে অট্টালিকা বানায়, কোটি টাকার গাড়িতে চড়ে। 

কারণ আরও আছে—দুর্নীতির বিস্তার, সমাজের ও পরিবারের নৈতিক বোধগুলো হারিয়ে যাওয়া, পণ্যসংস্কৃতির বলি হয়ে শুদ্ধতাকেও বলি দেওয়া। 

রাষ্ট্রকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—অপরাধ বাড়বে, অপরাধী সুরক্ষা পাবে, নাকি শিশুদের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ তৈরি করা হবে। তাহলে সর্বশক্তি নিয়ে ধর্ষকদের, মাদক ব্যবসায়ী ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে নামতে হবে। অপরাধী যখন জানবে অপরাধ করলে পার পাওয়া যাবে না, তখন ওই ভয় থেকেই হয়তো সে নিবৃত্ত হবে। পাশাপাশি স্কুল-মাদ্রাসা-কোচিং কেন্দ্রগুলোকে কঠোর নজরদারিতে রাখতে হবে, শিক্ষক নিয়োগে নৈতিকতাটি একটি আবশ্যকীয় মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আর সংস্কৃতির প্রসারে বিশেষ জোর দিতে হবে।

কাজটা রাষ্ট্রকেই শুরু করতে হবে। তাহলে সমাজে দ্রুতই একটি প্রতিরোধ গড়ে উঠবে। রাষ্ট্র নিষ্ক্রিয় থাকলে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অপরাধী-অনুকূল হলে সমাজ যত প্রতিরোধই গড়ুক না কেন, কাঙ্ক্ষিত ফল আসবে না এবং সমাজ হতোদ্যম হয়ে পড়বে। 

কাজটা কঠিন। আত্মার অসুখ এক দিনে সারে না, সময় লাগে। কিন্তু উদ্যম নিয়ে শুরু করলে সম্পূর্ণ নিরাময়-অযোগ্য হওয়ার আগে সেরে ওঠা সম্ভব।