বৃষ্টি যাদের জন্য অভিশাপ

ঘরের ভেতর পানিবন্দী হয়ে আছে মানুষ। গতকাল বেলা দুইটায় খাজা রোডের কসাইপাড়ায়।  জুয়েল শীল
ঘরের ভেতর পানিবন্দী হয়ে আছে মানুষ। গতকাল বেলা দুইটায় খাজা রোডের কসাইপাড়ায়। জুয়েল শীল

কাঠমিস্ত্রি মোহাম্মদ এনাম খাটের ওপর পা গুটিয়ে বসে বিড়ি ফুঁকছেন। বিছানাপত্রের পাশাপাশি রান্নার চালসহ প্রয়োজনীয় গৃহস্থালিসামগ্রীর ঠাঁই হয়েছে খাটে। মেঝেতে পানিতে থইথই করছে। হাঁটুর ওপর পর্যন্ত পানি। বিছানা ছুঁই ছুঁই। অসহায় দৃষ্টি এনামের।

গত সোমবার সকাল ১০টা থেকে এভাবে পানির সঙ্গে বসবাস করছে এনামের পরিবার। চান্দগাঁও খাজা সড়কের কসাইপাড়ায় তাঁর নিজের পৈতৃক বাড়ি। দুপাশে ইটের দুটি দেয়াল। মাঝখানে বেড়া দিয়ে ছোট ছোট তিনটি কক্ষ করা হয়েছে। ওপরের টিন ফুটো হয়ে পানি পড়ছে অঝোরে। নিচে বৃষ্টিজনিত জলাবদ্ধতা।

হাঁটু পরিমাণ পানি মাড়িয়ে অপর একটি কক্ষ থেকে উঁকি দিলেন এনামের মা লায়লা বেগম। ফিরিস্তি দিলেন ভোগান্তির। ‘কাল পানি আরও বেশি ছিল। নিচে ইট দিয়ে খাট ওপরে তোলা হয়েছে। এখন পানি একটু কমেছে। কিছু সেচ করে বাইরে ফেলে দেওয়া হয়। আমাদের এই ভোগান্তি প্রতি বর্ষাকালেই হয়।’

আরেক কামরায় স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে এনামের বড় ভাই নেজাম উদ্দিন থাকেন। তারা পানি ওঠার পর থেকেই পাশে এনামের চাচার ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন। এনামের স্ত্রী ও মেয়েও ওই ঘরে আছেন। ওই ঘরটি পাকা দালান। উচুঁ ভিটে। তবে বাড়িতে ঢোকার সময় হাঁটুসমান পানি মাড়াতে হবে।

এনাম বলেন, ‘পৈতৃক ভিটে। ভিটে ভরাট করে ঘর তোলার সামর্থ্য নেই। দুই ভাই এবং মাসহ থাকি কোনোরকমে। কষ্টে–সৃষ্টে দিন কেটে যায়।’

কথা বলতে বলতে এনামের দুই ভাইঝি উন্মে হাবিবা নাহার পানি ভেঙে পাশে স্বজনের ঘর থেকে নিজেদের ঘরের দুয়ারে আসে। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে সে। তার ভাই মিয়াজ উদ্দিন নবম শ্রেণিতে পড়ে। মিয়াজ বলে, ‘বই–খাতা ভিজে গেছে। স্কুলে যাওয়া বন্ধ। পাশে বড় চাচার বাসায় মাসহ কাল রাত থেকে আছি।’

পানির সঙ্গে বসবাসরত এনামদের নাওয়া–খাওয়া কার্যত বন্ধ। শুকনো খাবার কিংবা পাশের স্বজনের দেওয়া ভাতে তাদের জীবন চলছে।

গলির মধ্যে জমে থাকা পানিতে জাল দিয়ে মাছ ধরছেন এলাকার মানুষ। গতকাল বেলা দুইটায় খাজা সড়ক এলাকায়।  প্রথম আলো
গলির মধ্যে জমে থাকা পানিতে জাল দিয়ে মাছ ধরছেন এলাকার মানুষ। গতকাল বেলা দুইটায় খাজা সড়ক এলাকায়। প্রথম আলো

এনামের মতো খাজা সড়কের কসাইপাড়ার বেশির ভাগ বাড়িতেই সোমবার ভারী বৃষ্টিপাতের সঙ্গে সঙ্গে পানি ঢুকেছে। অনেক বাড়িতে গতকাল মঙ্গলবারও পানি ছিল। খাজা সড়কের বোচন মিস্ত্রির বাড়ি, সিদ্দিক খলিফা বাড়ির বিভিন্ন ঘরেও পানি ঢুকেছে।

সিদ্দিক খলিফা বাড়ির বাসিন্দা শামসুল আলম পাড়ায় ঢোকার সময় গলিতে জাল দিয়ে মাছ ধরছিলেন। শুক্রবার থেকে পাশের পুকুর ডুবে পাড়ার অলিগলি এবং ঘরবাড়ি পানিতে থইথই করছে। মাছ ধরছে অনেকে।

ঘরের অবস্থা কী জানতে চাইতেই শামসুলের বলেন, ‘ঘরে পানি এক কোমর। চলেন আপনাদের দেখিয়ে আসি।’

শামসুলের দেখানো পথে পানির মধ্যে পাঁচ মিনিট হেঁটে দেখা মিলল তাঁর ঘরের। ঘরের ভেতর কোমরসমান পানি। বিদ্যুৎ নেই। অন্ধকার। পানিতে ভাসছে চেয়ার–টেবিল বিছানাপত্র। সোমবার পানি আরও বেশি ছিল। গতকাল কিছুটা কমেছে।

শামসুলরা সাত ভাই একসঙ্গে এই পৈতৃক ভিটেতে থাকে। ঘরের বাসিন্দা কম করে ৩০ জন। সোমবার রান্না বন্ধ ছিল। চুলা ওপরে হওয়ায় গতকাল তাও আগুন জ্বালানো গেছে।

শামসুলের ভাবি সাজোয়ারা বেগম বলেন, ‘কাল কেউ ঘরে থাকতে পারিনি। পাশে মানুষের ঘরে না খেয়ে দেয়ে ছিলাম। আজ পানির মধ্যে চুলা জ্বেলেছি। কারণ এতজনের রান্না তো আর মানুষের বাসায় করা যায় না। আজও এখানে থাকা যাবে না। ছেলেপুলে আশপাশে মানুষের বাসায় আছে। আমরাও রাতে চলে যাব। বৃষ্টি মানেই আমাদের অভিশাপ।’