আসামিপক্ষের অনবরত হুমকিতে ভীত সাক্ষীরা

নুসরাত জাহান।
নুসরাত জাহান।

ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান হত্যা মামলার সাক্ষীরা আসামির স্বজনদের অব্যাহত হুমকির মুখে আছেন। এ জন্য আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় তাঁরা সব কথা তুলে ধরতে পারছেন না। সরেজমিনে মামলার সাক্ষীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

চাঞ্চল্যকর এ মামলার সাক্ষীর সংখ্যা ৯২। গত সোমবার পর্যন্ত ৯ জন আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। সাক্ষ্য দেওয়ার আগে তাঁদের বেশির ভাগ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হুমকির মুখে পড়েন।

আদালতে এই মামলায় আসামিদের কৌঁসুলি ১৬ জন। অন্যদিকে বাদীর কৌঁসুলি একজন। আর রাষ্ট্রের হয়ে একজন সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) লড়ছেন। আদালতে বাদীপক্ষের তেমন কেউ নেই। অথচ আসামিদের স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা শুনানির সময় আদালত চত্বরে ভিড় করেন। এতে সাক্ষীদের ওপর একধরনের মনস্তাত্ত্বিক চাপ পড়ছে।

গত ৬ এপ্রিল নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুনে পোড়ানো হয়। ১০ এপ্রিল চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান তিনি। পরে মামলার তদন্তের দায়িত্ব পেয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) মাদ্রাসার অধ্যক্ষসহ  ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে।

সরেজমিন চিত্র

গত রোববার বোরকা বিক্রেতা জসিম উদ্দিন ও তাঁর দোকানের কর্মচারী হেলাল উদ্দিন এবং কেরোসিন বিক্রেতা মো. লোকমান ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন। আসামি কামরুন্নাহার মনি জসিমের দোকান থেকে কালো বোরকা কিনেছিলেন। আর লোকমানের দোকান থেকে কেরোসিন কেনেন আসামি শাহাদাত হোসেন।

রোববার দুপুরে ফেনীর আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার আগের রাতে জসিম উদ্দিনকে হুমকি দেন আসামির লোকজন। আদালতে সঠিক বক্তব্য তুলে না ধরতে রাত আড়াইটা পর্যন্ত তাঁকে হুমকি দেওয়া হয়। পরে বাদীর কৌঁসুলির পরামর্শে তিনি মুঠোফোন বন্ধ করে দেন।

রোববার আসামির কৌঁসুলিরা একের পর এক প্রশ্ন করছিলেন জসিমকে। এতে তালগোল পাকিয়ে ফেলেন তিনি। একপর্যায়ে তিনি আদালতে বলেন, সাক্ষী হিসেবে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি সই করেছেন। কিন্তু সই করার আগে ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে বক্তব্য পড়ে শোনাননি কিংবা তিনি নিজেও বক্তব্য পড়েননি। পরে অবশ্য বিচারক তাঁকে আবার এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করেন। তখন জসিম বলেন, সই নেওয়ার আগে ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে বক্তব্য পড়ে শোনান।

জসিমের এমন সাক্ষ্য প্রসঙ্গে বাদীর কৌঁসুলি এম শাহজাহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শনিবার মধ্যরাত পর্যন্ত জসিমকে হুমকি দেওয়া হয়, যাতে আদালতে সত্য তথ্য উপস্থাপন না করেন। বারবার মুঠোফোনে কল আসার কারণে তাঁর ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটে। রাতেই বিষয়টি জানতে পেরে আমি তাঁকে মোবাইল ফোন বন্ধ করতে বলি।’

শাহজাহান জানান, শুধু জসিম নন, প্রত্যেক সাক্ষীকে আসামির স্বজনেরা হুমকি দিচ্ছেন। নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানোর কারণে সাক্ষীরা স্বাভাবিক কথা আদালতে বলতে পারছেন না। কিছু সাক্ষীকে লোভ দেখানো হচ্ছে বলেও জেনেছি। তবে সাক্ষীদের অভয় দিচ্ছি, যাতে আসল ঘটনা তাঁরা আদালতে তুলে ধরেন। কারণ সরকারও এ মামলাটির ব্যাপারে অত্যন্ত সজাগ। ভয় দেখিয়ে কোনো লাভ হবে না।’

আদালতে বিভ্রান্তিকর কথা বলার কারণ জানতে চাইলে বোরকা বিক্রেতা জসিম উদ্দিন হুমকি পাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘কাঠগড়ায় আঁর গা কাঁপছিল। কী কইতে কী কইছি মনে নাই।’

শুধু জসিম উদ্দিন নন, প্রায় সব সাক্ষীকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তদন্তকারী সংস্থা পিবিআইয়ের কর্মকর্তারা পুরো বিষয়টি জানতে পেরেছেন। এ জন্য সাক্ষীদের নিরাপত্তা ছাড়াও আসামির স্বজনদের গতিবিধির ওপর নজর রাখছে পিবিআই।

পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মঈন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলার কাজ দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা গুছিয়ে এনেছিলাম। সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হলে আসামির স্বজনদের অপতৎপরতা বেড়ে যায়। সাক্ষীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন কিংবা লোভ দেখানোর বিষয়টি আমরা জেনেছি। সবকিছু নজরদারিতে আছে।’

>

আদালতে বাদীর কৌঁসুলি একজন
রাষ্ট্রের হয়ে একজন পিপি লড়ছেন
অন্যদিকে আসামিদের কৌঁসুলি ১৬
চাঞ্চল্যকর এ মামলার সাক্ষী ৯২ জন
আদালতে বাদীপক্ষের তেমন কেউ নেই
আসামিদের লোকজন আদালত চত্বরে ভিড় করেন

মঈন উদ্দিন বলেন, ‘ফেনীর আদালতে বাদীর পক্ষে দুজন আইনজীবী কাজ করছেন। আসামির পক্ষে ১৬ জন আইনজীবী। এ ছাড়া সাক্ষ্য গ্রহণের সময় আসামির স্বজন ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা আদালত চত্বরে অবস্থান নেন। বিভাগীয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে মামলাটি স্থানান্তর হলে আসামিপক্ষের লোকজনের এই দাপট থাকত না।’

পাঁচ আসামির কৌঁসুলি আহসান কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসামির স্বজনেরা বাইরে কী করছেন, তা আমার জানার সুযোগ নেই। তবে আমার মক্কেলদের নির্দোষ প্রমাণের জন্য আইনিভাবে যা করার সবই করছি।’

গত রোববার ফেনীর আদালত চত্বরে আসামিদের অসংখ্য স্বজন এবং অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার শুভাকাঙ্ক্ষী ও কিছু ছাত্রকে দেখা যায়। এজলাস এবং বাইরে বিপুলসংখ্যক পুলিশও ছিল। ওই দিন তিনজন সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্য শেষে তিনজনকে পুলিশের গাড়িতে তুলে সোনাগাজী পৌঁছে দেওয়া হয়।

৪ জুলাই আদালতে সাক্ষ্য দেন মাদ্রাসার নৈশপ্রহরী মো. মোস্তফা। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে তিনি ঘটনার চিত্র তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় তিনি সবকিছু মন খুলে বলতে পারেননি। সাক্ষ্য দেওয়ার আগে তাঁকে আসামির কিছু স্বজন সব কথা বলতে বারণ করেন। এ কারণে অধ্যক্ষ সম্পর্কে সবকিছু খোলাখুলি আদালতে বলেননি বলে এই প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেন তিনি। কয়েকজন লোক তাঁকে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় নিজের স্ত্রী–সন্তানদের কথা মনে রাখার কথা বলে পরোক্ষভাবে হুমকি দেন। কাঠগড়ায় সাক্ষ্য দিতে দাঁড়ালে দু–একজন আসামি ও তাঁদের স্বজনেরা তাঁকে চোখের ইশারা দেন।

আসামির ওই স্বজনদের পরিচয় জানতে চাইলে মোস্তফা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘হেতারগো নাম কইলে আঁর ক্ষতি অইবো।’

অধ্যক্ষের ব্যক্তিগত সহকারী নুরুল আমিন সাক্ষ্য দেন ৩ জুলাই। তাঁকে আসামির স্বজনেরা আদালতে বেশি কথা না বলতে হুমকি দেন।

নুরুল আমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাক্ষ্য দেওয়ার আগে আদালতে সরাসরি কারও বিরুদ্ধে বলতে শোনা গেলে পরিণাম ভালো হবে না বলে আমাকে শাসানো হয়। আমি যতটুকু জানি, আদালতে তা বলেছি।’

মামলার অন্যতম সাক্ষী নিহত নুসরাতের সহপাঠী নাসরিন সুলতানা ও নিশাত সুলতানার পরিবার ও স্বজনেরা জানান, আসামিদের বিরুদ্ধে সরাসরি কিছু বললে পরিণাম ভালো হবে না বলে হুমকি দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো হুমকির মুখে নাসরিন ও নিশাত মাথা নত করেননি।

নাসরিন সুলতানার বাবা সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের অজ্ঞাতনামা কয়েকজন লোক হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু নাসরিন হুমকিতে ভয় পায়নি। পুলিশি পাহারায় আদালতে গিয়ে সহপাঠী হত্যার বিচার চেয়ে আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে এসেছে।

সাক্ষীদের হুমকি প্রসঙ্গে নুসরাতের বড় ভাই ও বাদী মাহমুদুল হাসান সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তাঁর পক্ষে আইনজীবী সব বলবেন বলে জানান।

ফেনীর আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) হাফেজ আহাম্মদ সাক্ষীদের হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। মামলার সামগ্রিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসামিপক্ষে ১৬ আইনজীবী লড়ছেন। আর আমরা দুজন। আসামির আইনজীবীরা সাক্ষীদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এসব করে, হুমকি দিয়ে বা লোভ দেখিয়ে কোনো কাজ হবে না।’