এক বছর ধরে অফিস সহকারীই চিকিৎসক!

রংপুর
রংপুর

রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার রাধানগর উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে শিশু থেকে শুরু করে সব রোগীর সর্বরোগের চিকিৎসা দিচ্ছেন এক অফিস সহকারী। বাইরে থেকে ওষুধ কেনার ব্যবস্থাপত্রও লিখে দেন তিনি। গত এক বছর ধরে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে ওই অফিস সহকারী চিকিৎসা দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

অভিযুক্ত অফিস সহকারীর নাম মিনজুর রহমান। তিনি অকপটে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘এখানে চিকিৎসক ও ফার্মাসিস্ট কেউ নেই। তাই আমি চিকিৎসা দিয়ে আসছি। এখানে থাকতে থাকতে আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে। তা ছাড়া স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার প্রশিক্ষণও আমার আছে। আমার দেওয়া চিকিৎসায় রোগীরা ভালো হচ্ছেন।’

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, ওই ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রটি ১৯৬৫ সালে উপজেলার তৃতীয় বৃহত্তম হাটবাজার লালদিঘীহাটে স্থাপন করা হয়। প্রতিদিন গড়ে ৮০-৯০ জন রোগী সেখানে চিকিৎসা নেন। উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে একজন এমবিবিএস চিকিৎসক, উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল কর্মকর্তা, ফার্মাসিস্ট ও এমএলএসএস বা অফিস সহকারীর (পিয়ন) চারটি পদ আছে।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র অনুযায়ী, এমবিবিএস চিকিৎসকের পদ চার বছর, উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল কর্মকর্তার পদ তিন বছর এবং ফার্মাসিস্টের পদ দুই বছর ধরে শূন্য আছে। চিকিৎসক না থাকায় দুই বছর আগে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ওই উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা দেওয়ার অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে উপজেলার লোহানীপাড়া ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল কর্মকর্তা মনিরুজ্জামানকে। বিধিমোতাবেক কোনো রোগী দেখার এখতিয়ারও উপসহকারী মেডিকেল কর্মকর্তার নেই। তবুও তিনি রোগী দেখেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে।

গত সোমবার বেলা ১১টার দিকে ওই উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, কেন্দ্রটির এমএলএসএস মিনজুর রহমান চিকিৎসকের চেয়ারে বসে চিকিৎসা দিচ্ছেন। এ সময় ছয় বছর বয়সের অসুস্থ সন্তানকে কোলে নিয়ে রাধানগর ইউনিয়নের দফাদারপাড়া গ্রামের আরশি বেগম (৩০) ওই অফিস সহকারীকে চিকিৎসক ভেবে বলেন, ‘স্যার, আমার ছেলের তিন দিন ধরে সর্দি জ্বর। আমার পেট ব্যথা করে মোচড় দিয়ে উঠছে।’ মিনজুর রহমান চিকিৎসা হিসেবে ওই শিশুকে চারটি প্যারাসিটামল ট্যাবলেট এবং মা আরশি বেগমকে চারটি মেট্রোনিডাজোল ট্যাবলেট দিলেন। ওই ট্যাবলেট দিনে দুবার করে শিশু ও মাকে খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

লালদীঘি পীরপাল কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ফারুক হোসেনও (১৮) ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ওই সময় চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন। তাঁর মুখ থেকে রোগের বর্ণনা শুনে চারটি করে প্যারাসিটামল, অ্যান্টাসিড ও বি কমপ্লেক্স ট্যাবলেট দিয়ে ওই পিয়ন বলেন, ‘এগুলো খাও, ঠিক হয়ে যাবে।’

ওই দিন দুপুর ১২টা পর্যন্ত ওই উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসা রেজিস্ট্রারে দেখা যায়, মিনজুর ওই সময় পর্যন্ত ৬৫ জন রোগীর চিকিৎসা দিয়েছেন।

রাধানগর ইউনিয়নের দক্ষিণ খামারপাড়া গ্রামের জালাল উদ্দিন (৩৮) অভিযোগ করে বলেন, ‘এখানে এক বছর ধরে চিকিৎসক বসে না। অফিস সহকারী হাসপাতালটি খুলে চিকিৎসকের চেয়ারে বসে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা দিচ্ছেন। হাসপাতালে ওষুধ না থাকলে ব্যবস্থাপত্র লিখে দেন। রোগীরা ওষুধের দোকান থেকে তা কিনে খাচ্ছেন। কিন্তু গ্রামগঞ্জের রোগীরা আজও জানেন না তিনি চিকিৎসক নন।’

একজন অফিস সহকারী হয়েও চিকিৎসকের চেয়ারে বসে চিকিৎসা দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মিনজুর রহমান বলেন, ‘ভাই, চিকিৎসা দেওয়ার এখতিয়ার তো আমার নেই। চিকিৎসক না থাকায় এবং কিছুটা অভিজ্ঞতা থাকার কারণে আমাকে এখানে (উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে) রোগী দেখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।’ কে দিয়েছেন অনুমতি—জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান তাঁকে এ অনুমতি দেন।

মুঠোফোনে জানতে চাইলে মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমি তাঁকে চিকিৎসা দেওয়ার কোনো অনুমতি দিইনি।’ মনিরুজ্জামান দাবি করেন, কেন্দ্রটিতে তিনি গিয়ে চিকিৎসা দেন। কিন্তু রোববার রাতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দায়িত্ব পালন করায় সোমবার ওই উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে তিনি যেতে পারেননি।

পরদিন মঙ্গলবার সরেজমিনে গিয়েও ওই উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে পিয়ন মিনজুর রহমানকে চিকিৎসা দিতে দেখা গেছে। এ প্রসঙ্গে মনিরুজ্জামান বলেন, ‘ভাই, আজ দিনে (মঙ্গলবার) উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগী দেখছি। এত রোগী রেখে কীভাবে সেখানে যাব?’

এ ব্যাপারে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আরশাদ হোসেন বলেন, ‘আমি দুই দিন আগে এখানে যোগদান করেছি। ওই উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রের কী অবস্থা তা জানি না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অফিস সহকারীর চিকিৎসা দেওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই। বিষয়টি দেখে ব্যবস্থা নেব।’