রোহিঙ্গাদের কারণে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে: প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘তাদের আমরা মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু তাদের কারণে আমাদের ওই অঞ্চলের (কক্সবাজার) প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে।’
জলবায়ুবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন ‘গ্লোবাল কমিশন অন অ্যাডাপটেশন’র (জিসিএ) ঢাকা বৈঠকে প্রধান অতিথির ভাষণে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। আজ বুধবার সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় দুই দিনব্যাপী এ সম্মেলন শুরু হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ওখানে (কক্সবাজারে) আমাদের যত পাহাড়ি এলাকা বা জঙ্গল ছিল, সেগুলো কেটে-ছেঁটে বসতি স্থাপন করা হচ্ছে। এর ফলে এলাকাটি অনেকটা অনিরাপদ এবং ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। এ জন্য আমরা চাই দ্রুততম সময়ে তারা নিজ দেশে ফেরত যাক। তারা যত তাড়াতাড়ি নিজেদের দেশে ফিরে যাবে, ততই তা বাংলাদেশের জন্য মঙ্গল।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তনের বিস্তৃতি এবং এর প্রভাব প্রশমনে নিজেদের সক্রিয় উদ্যোগ সম্পর্কে আরও সচেতন হতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আপনাদের সবাইকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় সচেতন থাকতে এবং নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের অনুরোধ করছি। বর্তমান বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-উদ্ভাবন ও অর্থায়নের যুগে জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের অনেক সুযোগ রয়েছে, যা সবাই সহজে কাজে লাগাতে পারি। তথাপি আমি বলতে চাই, অভিযোজনের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সে জন্য সুষ্ঠু প্রশমন ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে অভিযোজন প্রক্রিয়ার সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না।’
আজকের অনুষ্ঠানে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের প্রেসিডেন্ট হিলদা সি হেইন, গ্লোবাল কমিশন অন অ্যাডাপটেশনের চেয়ারম্যান ও জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন এবং সম্মেলনের কো-চেয়ার এবং বিশ্বব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ক্রিস্টালিনা জর্জিওভা উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় সামনের সারিতে থেকে বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনন্য নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন।
জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশের গৃহীত পদক্ষেপ ও কৌশল সম্পর্কে বান কি মুন বলেন, ‘অবশ্যই আমরা এখানে বাংলাদেশের কাছে শিখতে এসেছি। অভিযোজনের বিষয়ে শেখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশই হচ্ছে সবচেয়ে ভালো শিক্ষক।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এবং পরিবেশ, বন এবং জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনও অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গ্লোবাল কমিশন অব অ্যাডাপটেশনের সহযোগিতায় আমরা জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় সঠিক অভিযোজন কৌশলের পাশাপাশি সাশ্রয়ী পন্থা ও ঝুঁকি নিরসন ব্যবস্থার সুবিধা পেতে চাই।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছি আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ মহাসচিবের আহ্বানে অনুষ্ঠেয় ক্লাইমেট চেঞ্জ সামিটের প্রতিবেদনের সুপারিশগুলোর জন্য। ওই সম্মেলনে এলডিসিভুক্ত দেশগুলো ও বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আমাকে বক্তব্য দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব অনুমিত সময়ের আগেই আমাদের প্রত্যেকের ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। সে জন্য এর প্রভাব মোকাবিলায় বিশ্বকে বিনিয়োগে আরও বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমি শুধু নিজের দেশ নিয়ে ভাবি না। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে অনেক ছোট দ্বীপপুঞ্জ হারিয়ে যাবে। তখন সেখানকার মানুষেরা কোথায় যাবে, সে কথাও আমাদের ভাবতে হবে।’
জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বড় হুমকি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী পৃথিবীর উষ্ণতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এডিবির জলবায়ু এবং অর্থনীতিবিষয়ক প্রতিবেদনের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আমাদের বার্ষিক জিডিপি ২ শতাংশ কমে যাবে। যদি বর্তমান হারে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে, তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে আমাদের ১৯টি উপকূলীয় জেলা স্থায়ীভাবে ডুবে যাবে।’
নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে সমুদ্রতল এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের বিস্তৃত এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ বলছে, বাংলাদেশে ইতিমধ্যে ৬০ লাখ জলবায়ু অভিবাসী রয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে এটি বেড়ে দ্বিগুণের বেশি হতে পারে; যা দেশের খাদ্যনিরাপত্তায় হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে।’
তিনি বলেন, তাঁর সরকারের অক্লান্ত পরিশ্রমে গত এক দশকে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক খাতে যে বিশাল উন্নতি হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাবে আজ তা হুমকির সম্মুখীন।
জনগণের জন্য অভিযোজনব্যবস্থা তৈরি করতে তাঁর সরকারের নিরলসভাবে কাজ করার প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘গত এক দশকে আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো অভিযোজনের মাধ্যমে নিরসনের জন্য বছরে প্রায় ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করছি।’
এ সময় তিনি জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড গঠন এবং বাংলাদেশের নিজস্ব তহবিল থেকে জলবায়ু অভিযোজন কর্মসূচির জন্য ৪২ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি এই ফান্ডে বরাদ্দের কথাও উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের সাফল্য তুলে ধরে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় অর্থপূর্ণ সহযোগিতার জন্য ২০১৫ সালে প্যারিসে বিশ্ব সম্প্রদায় একটি সুদৃঢ় অবস্থান তৈরিতে সফল হয়েছে।
সরকারপ্রধান বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবিলায় আমরা নিজস্ব কৌশল অবলম্বন করেছি। লবণাক্ততা, বন্যা ও খরাসহিষ্ণু ফসলের প্রজাতি উদ্ভাবন এবং চাষের মাধ্যমে এ বিষয়ে আমাদের সক্ষমতা গড়ে তুলেছি।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান আজকে সবার সামনে উপস্থাপনের এক অনন্য সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুধু ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে সাত লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় দেড় লাখ মানুষ মারা যায়। ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডরে মারা যায় ৩ হাজার ৪০০ জনের বেশি মানুষ। ২০০৯ সালের মে মাসে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সাইক্লোন আইলার প্রভাবে ১১৯ জনের মতো মানুষ মারা যায়। আর ২০১৯-এর মে মাসে বয়ে যাওয়া সাইক্লোন ফণীতে কেউ মারা না গেলেও সে সময় অন্যান্য কারণে ১০ জন প্রাণ হারায়।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরে এ ক্ষেত্রে ব্যাপক গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ করেন প্রধানমন্ত্রী।