জনসংখ্যা নীতিতে আবার দুই সন্তান

ছবি: সংগৃহীত
ছবি: সংগৃহীত

জনসংখ্যা নীতিতে সরকার অবস্থান বদলেছে। এখন পুরোনো স্লোগান দিচ্ছে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। তারা বলছে: ‘ছেলে হোক মেয়ে হোক, দুটি সন্তানই যথেষ্ট’। এক দশকের বেশি সময় ধরে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মূল স্লোগান ছিল: ‘দুটি সন্তানের বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়’।

সরকারের এই অবস্থান পরিবর্তন দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ওপর প্রভাব ফেলবে বলে জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘জনসংখ্যা বৃদ্ধির বর্তমান যে ধারা, তাতে স্লোগান পরিবর্তনের উপযুক্ত সময় এটা নয়। প্রতিটি দম্পতি দুটি করে সন্তান জন্ম দিচ্ছে—এমন প্রজনন হারকে বলে “প্রতিস্থাপনযোগ্য জনউর্বরতা” বা “রিপ্লেসমেন্ট লেভেল ফার্টিলিটি”। দেশে “প্রতিস্থাপনযোগ্য জনউর্বরতা” হওয়ার পরই সরকারের স্লোগান পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। এখন জনসংখ্যার ব্যাপক বৃদ্ধির ঝুঁকিটা থেকেই গেল।’

সরকারি কর্মকর্তা ও জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করেছে। যেমন স্বাধীনতার সময় ১৫-৪৯ বছর বয়সী নারী গড়ে ছয়টির বেশি সন্তান জন্ম দিতেন। অর্থাৎ তখন মোট প্রজনন হার (টিএফআর) ছিল ৬ দশমিক ৪। বর্তমান টিএফআর নিয়ে বিতর্ক আছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, ২ দশমিক শূন্য ৫, জনমিতি জরিপ বলছে, ২ দশমিক ৩। স্বাধীনতার সময় আধুনিক জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করতেন ৮ শতাংশ দম্পতি। এখন সেই হার ৬৩ শতাংশ।

জাতীয় জনসংখ্যা নীতিতে ২০১৫ সালের মধ্যে প্রতিস্থাপনযোগ্য জনউর্বরতা অর্জন করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। একই সময়ে আধুনিক জন্মগ্রহণ পদ্ধতি গ্রহীতার হার ৭২ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। দুটির কোনোটিই অর্জিত হয়নি। দেশে এখনো মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু অনেক বেশি।

বিবিএসের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫৫ লাখ। দেশের বাইরে থাকা প্রায় ১ কোটি প্রবাসী এই হিসাবের বাইরে। নগররাষ্ট্র ছাড়া বিশ্বে সবচেয়ে জনবহুল দেশ বাংলাদেশ। এ দেশে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১ হাজার ২৬৫ মানুষ বাস করে (চীনে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৫০, ভারতে ৪৫০ জন)। প্রতিবছর মোট জনসংখ্যার সঙ্গে নতুন করে প্রায় ৩২ লাখ মানুষ যোগ হচ্ছে। জনসংখ্যার এই চাপ পড়ছে জমির ওপর, খাদ্যের ওপর, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের ওপর। একসময় বলা হতো, জনসংখ্যা দেশের এক নম্বর সমস্যা।

জনসংখ্যা নীতির বিষয়ে সরকারের অবস্থান পরিবর্তনের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য অধ্যাপক শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এক সন্তানের নীতি বাংলাদেশে কখনো ছিল না। সন্তান গ্রহণের ব্যাপারে পরিবারই স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেবে, এটাই মূল কথা। সরকার জনসংখ্যা ব্যবস্থাপনায় বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। এ কথা সত্যি যে বসতি, পরিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের ওপর অধিক জনসংখ্যা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।’

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ‘ছেলে হোক মেয়ে হোক, দুটি সন্তানই যথেষ্ট’ স্লোগান আশির দশকের। ২০০৪ সালে জনসংখ্যা দিবসে ‘দুটি সন্তানের বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়’ স্লোগানটি ব্যবহার করা হয়, যা ২০১২ সালে জাতীয় জনসংখ্যা নীতিতে জোরদারের কথা বলা হয়। সরকার একসময় এক সন্তানের নীতি গ্রহণ করা যায় কি না, সেই চিন্তাও করেছিল। তবে বর্তমান সরকারের অনেকেই জনসংখ্যাকে দেশের জন্য বড় সমস্যা মনে করেন না।

গত বছর অক্টোবরে স্লোগান পরিবর্তনের একটি পরিপত্র জারি করে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর। পরিপত্রে ‘ছেলে হোক মেয়ে হোক, দুটি সন্তানই যথেষ্ট’কে মূল স্লোগান হিসেবে গ্রহণ করার কথা বলা হয়।
আজ বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য: জনসংখ্যা ও উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ২৫ বছর: প্রতিশ্রুতির দ্রুত বাস্তবায়ন। মূলত ২৫ বছর আগে মিসরের কায়রোতে অনুষ্ঠিত জনসংখ্যাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গ্রহণ করা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কথাই এই প্রতিপাদ্যে বলা হচ্ছে।

দিবসটি উপলক্ষে গতকাল বুধবার সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলাম, পরিবারকল্যাণ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব শেখ ইউসুফ হারুন, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক আশরাফুন্নেসা প্রমুখ।

সরকারের জনসংখ্যা নীতিতে পরিবর্তন বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সরকারি কর্মকর্তারা বলেন, চীন এক সন্তান নীতি থেকে সরে এসেছে। আরও কিছু দেশের অভিজ্ঞতা ভালো না।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চীন, জাপান ও ইউরোপের কিছু দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, এক সন্তানের পরিবারের শিশুরা একাকিত্বে ভোগে। এ ছাড়া আরও কিছু সামাজিক সমস্যা দেখা দেয়। অনেক দেশেই যুব জনগোষ্ঠীর সংকট দেখা দিয়েছে। এসব অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশ জনসংখ্যানীতিতে পরিবর্তন এনেছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে আজ দেশে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালিত হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। শোভাযাত্রার পর রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে একটি আলোচনা অনুষ্ঠান হওয়ার কথা আছে।

জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম মনে করেন, বাংলাদেশে ১৫-১৯ বছর বয়সী কিশোরী মা অনেক বেশি। এদের মধ্যে ১৭ শতাংশ প্রয়োজনের সময় জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী পায় না। অধিক সন্তান নিলে ক্ষতি নেই, এমন বার্তা যাওয়ার আশঙ্কা আছে।