ডেঙ্গুতে মৃত্যু বেড়ে ১১, নগরবাসী অসহায়

তাফিফ তাওরাতের বয়স সাড়ে তিন বছর। ডেঙ্গু শনাক্ত হওয়ার পর ৭ জুলাই তাকে রাজধানীর একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গতকাল শুক্রবার হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, শিশু তাফিফের পাশে ম্লান মুখে বসে আছেন মা। এক খালা চোখ মুছতে মুছতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।

শিশুটির বাবা মুঠোফোনে বিভিন্নজনের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন রক্তের জন্য। শিশুটির জন্য এ পজিটিভ রক্তের প্রয়োজন। সাত মাস বয়সে শিশুটির প্রথম ডেঙ্গু হয়েছিল।

বিকেলে তাফিফ তাওরাতকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হয়। বাবা মো. মহিউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি অসহায় হয়ে পড়েছি। ছেলেটার এই বয়সে দুবার ডেঙ্গু হলো। আমি নিয়মিত কর পরিশোধ করি। অথচ মেয়র মশা মারতে পারছেন না। এখন শুনছি মশা মারার ওষুধ অকার্যকর। সরকারও নির্বিকার। এই দায়দায়িত্ব সরকার বা মেয়র এড়াতে পারেন না। তাঁদের ব্যর্থতার কারণে আমরা কেন হাসপাতালে এত টাকা ব্যয় করব?’

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলছেন, এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।

এরই মধ্যে এপ্রিল থেকে জুলাইয়ে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১১ জন। এর আগে ৩ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছিল সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। গত বছর একই সময়ে মৃত্যু হয়েছিল সাতজনের। সরকার ডেঙ্গুতে আক্রান্তের যে সংখ্যা প্রচার করছে, প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি।

আইইডিসিআরের মৃত্যু পর্যালোচনাবিষয়ক কমিটির দুজন সদস্য গতকাল ১১ জনের মৃত্যুর তথ্য প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, এই সপ্তাহে তাঁরা সুপারিশসহ চূড়ান্ত প্রতিবেদন আইইডিসিআরকে দেবেন।

গেল কয়েক বছরের তুলনায় এবার ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জুলাই মাসে গতকাল পর্যন্ত ১২ দিনে মোট ১ হাজার ৬৪৩ জন আক্রান্ত রোগী সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। অর্থাৎ দিনে গড়ে ১৩৭ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। তবে প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা আরও বেশি।

ভাইরাসজনিত ডেঙ্গু জ্বর এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়। মশা মারতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন যে ওষুধ ব্যবহার করে, তা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (সিডিসি) পৃথক দুটি গবেষণায় দেখেছে, এই ওষুধে মশা মরছে না।

মৃত্যু বাড়ছে

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিল মাসে আক্রান্ত দুজন ডেঙ্গু রোগী মারা যান। আর ২ জুলাই মারা যান একজন। এই তিনজনের মৃত্যুর কথা সরকার প্রকাশ করলেও গত কয়েক দিনে আর কোনো সরকারি তথ্য পাওয়া যায়নি।

ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়াসহ কিছু রোগে মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে আইইডিসিআরের ৮ সদস্যের মৃত্যু পর্যালোচনা কমিটি। আইইডিসিআরের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ কমিটির সদস্য, ভাইরাস বিশেষজ্ঞ, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, শিশু বিশেষজ্ঞরা এই কমিটির সদস্য। গতকাল আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সাব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, কমিটি মৃত্যুর সংখ্যা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মৃত্যুর কারণ বর্ণনা ও সুপারিশ করে। তবে তিনি মৃত্যুর সংখ্যা বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, ‘আগামী সপ্তাহে সব জানতে পারবেন।’

গতকাল সকালে কমিটির একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, এপ্রিল–জুলাইয়ে মোট ১৪টি মৃত্যুর ঘটনা পর্যালোচনা করে হয়েছে। এর মধ্যে ১১টি মৃত্যু হয়েছে ডেঙ্গুতে। অন্য তিনটি ক্ষেত্রে সঠিক ও পর্যাপ্ত কাগজপত্র ছিল না।

>

ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুর বাবা বললেন,আমি নিয়মিত কর পরিশোধ করি
অথচ মেয়র মশা মারতে পারছেন না
এখন শুনছি মশা মারার ওষুধ অকার্যকর

কমিটির আরেকজন সদস্য বলেছেন, ১১টি মৃত্যু পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রোগীরা একাধিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। অর্থাৎ রোগীরা অপেক্ষাকৃত উন্নত বা ভালো চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল পরিবর্তন করেছেন। এ মাসের প্রথম সপ্তাহে একজন চিকিৎসক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের একটি বড় বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার আগে ওই চিকিৎসক অন্য আরেকটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিলেন।

প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণকক্ষ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের এবং ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করছে। ১২টি সরকারি ও আধা সরকারি এবং ৩৫টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে তথ্য নিয়ে তারা তালিকা তৈরি করে। গতকাল নিয়ন্ত্রণকক্ষের তালিকায় দেখা যাচ্ছে, গতকাল বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ছিল ১ হাজার ৫৯ জন।

ওই তালিকায় রাজধানীর গ্রিন রোডের গ্রিন লাইফ হাসপাতালের নাম আছে। সরকারি হিসাবে গতকাল ওই হাসপাতালে কোনো রোগী ভর্তি ছিল না। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন।

গতকাল দুপুরে গ্রিন লাইফ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. নাজিয়া হক প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালে ভর্তি আছে ৩৫ জন রোগী। এদের মধ্যে শিশু ১৫ জন।

এ ছাড়া তালিকায় ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নাম থাকলেও রোগী ভর্তির কোনো তথ্য ছকে নেই। ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. আশীষ কুমার চক্রবর্তী জানান, গতকাল হাসপাতালে ২৬ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। এর মধ্যে শিশু ৭ জন।

একইভাবে তালিকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) নাম থাকলেও সেখানে কোনো রোগী ভর্তি নেই বলে উল্লেখ আছে। বিএসএমএমইউর আবাসিক চিকিৎসক হাসান ইমাম বলেন, প্রতিদিন বহির্বিভাগে কমপক্ষে ৫০ জন ডেঙ্গু রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। গতকাল ভর্তি ছিল ১ জন।

রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বারডেম হাসপাতালের শিশু বিভাগে এ বছর ৭২ জন রোগী ভর্তি হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, প্রায় সমানসংখ্যক শিশুকে বহির্বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।

সব হাসপাতাল ও ক্লিনিকের তথ্য জোগাড় করতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। যেসব হাসপাতালের তথ্য দিচ্ছে, তা–ও আংশিক। অন্যদিকে হাসপাতালের বাইরে অনেক রোগী চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে চিকিৎসা নিচ্ছে। সেই তথ্য কারও কাছে নেই। পরিস্থিতি উদ্বেগজনক বলে অনেকেই মনে করছেন।

উদ্বেগ বাড়ছে

গতকাল বিকেলে পরিস্থিতি নিয়ে মুঠোফোনে কথা হয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, এই সপ্তাহে স্বাস্থ্য, পরিবেশ, বিজ্ঞানী, গবেষকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে পরামর্শ সভার ডাক দেওয়া হয়েছে। এতে মূলত মশার ওষুধ পরিবর্তন করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। এ ছাড়া নাগরিকদের স্বস্তি ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বিশিষ্টজনদের পরামর্শও নেওয়া হবে।

বর্তমান ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ খান আবুল কালাম আজাদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০০০ সালে এই শহরে প্রথম ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। ২০০৯ সাল থেকে ঢাকার এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি। এখন দিনে গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ জন ডেঙ্গুর রোগী ভর্তি হচ্ছে ঢাকা মেডিকেলে। এত রোগী কখনো ভর্তি হতে দেখিনি।’

বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় নিয়মিত জনস্বাস্থ্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ঢাকা শহরের নাগরিকেরা সাধারণত মশা নিধনের ওপর গুরুত্ব দেয়। তারা চায় সরকার নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটাক। কিন্তু এবার প্রথম তারা জানতে পারল, সিটি করপোরেশন যে ওষুধ ছিটায় তা অকার্যকর। এটা নাগরিকদের মধ্যে নতুন উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।