রোহিঙ্গা গণহত্যায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হচ্ছে

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ সংঘটনে অভিযোগ রয়েছে মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। ছবি: রয়টার্স
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ সংঘটনে অভিযোগ রয়েছে মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। ছবি: রয়টার্স

গণহত্যা আর মানবতাবিরোধী অপরাধ চালিয়ে রোহিঙ্গাদের যেভাবে রাখাইন থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তা বিশ্বাস করার যৌক্তিক কারণ খুঁজে পেয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের তথ্যানুসন্ধানকারী দল। এ নিয়ে তদন্ত শুরু করতে গত সপ্তাহে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) অনুমতি চেয়েছেন আদালতের কৌঁসুলি ফেতু বেনসুদা। তদন্তসহ বিচারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে বাংলাদেশে মাঠপর্যায়ে আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু করতে যাচ্ছে আইসিসি।

ঢাকা এবং হেগের কূটনৈতিক সূত্রগুলো গত সপ্তাহে প্রথম আলোকে জানিয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্তের জন্য বাংলাদেশে দাপ্তরিক কাজ শুরু করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে আইসিসির কৌঁসুলির দপ্তর। এর সঙ্গে যুক্ত প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো নিয়ে ঢাকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলতে আইসিসির উপ-কৌঁসুলি জেমস স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ১৬ জুলাই বাংলাদেশে আসছে।

রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্তের মধ্য দিয়ে মূলত মিয়ানমারের অভিযুক্ত জেনারেলদের বিচারে একধাপ এগিয়ে যাচ্ছে নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত আইসিসি। প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধানে নৃশংস ওই সব অপরাধের প্রমাণ পাওয়ায় এটা স্পষ্ট যে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বা আদালতে হাজির হওয়ার মতো সুপারিশ তুলে ধরার সুযোগ পাবে আইসিসির কৌঁসুলির দপ্তর। ওই সুপারিশের ভিত্তিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিচারকেরা প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পারবেন।

প্রসঙ্গত, জাতিসংঘের সত্যানুসন্ধানী দল ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা নিপীড়নের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দিয়েছিল। ওই প্রতিবেদনে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নির্বিচারে হত্যা, গণধর্ষণ ও বর্বরতা চালানোর মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধ পরিচালনার অভিযোগে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইংসহ ছয় জেনারেলকে আইসিসিতে বিচারের সুপারিশ করা হয়েছিল।

এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশ রোম সনদে সই করলেও এতে পক্ষ হয়নি মিয়ানমার। রোম সনদের সই করেনি বলে মিয়ানমার আইসিসির কাছে রোহিঙ্গা বিতাড়নে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে কি না, তা নিয়ে কোনো পর্যবেক্ষণ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। আইসিসির কৌঁসুলি ফেতু বেনসুদা প্রাক্-বিচারিক আদালতের শুনানিতে বলেছেন, রোহিঙ্গারা নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। যেহেতু মিয়ানমারের সংখ্যালঘু ওই জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে গেছে এবং বাংলাদেশ রোম সনদে সই করেছে, তাই এ নিয়ে আইসিসির তদন্তের এখতিয়ার আছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত প্রতিস্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯৮ সালের জুলাইতে ইতালিতে এক কূটনৈতিক সম্মেলনে রোম সনদ সই হয়। এই সনদ আদালতের কর্মকান্ড, কাজের পরিধি ও কাঠামো ঠিক করে দিয়েছে।

নেদারল্যান্ডসের কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, জেমস স্টুয়ার্টের নেতৃত্বাধীন আইসিসির প্রতিনিধিদলটি ১৬ থেকে ২১ জুলাই বাংলাদেশ সফর করবে। এ সফরের সময় আইসিসির প্রতিনিধিরা আইন, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। পাশাপাশি তাঁরা জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলবেন। পাঁচ দিনের সফরের সময় আইসিসির কর্মকর্তারা কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গাদের কাছেও পরিস্থিতি সম্পর্কে খোঁজ নেবেন।

আইসিসি প্রতিনিধিদলের সফর নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গত শুক্রবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গা নিপীড়নের ঘটনায় প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করবে আইসিসির প্রতিনিধিদল। বাংলাদেশ তাদের প্রয়োজনীয় সব সহায়তা দেবে। তদন্ত প্রতিবেদন তৈরির জন্য নির্যাতিত লোকজনের (রোহিঙ্গা) সঙ্গে তারা কথা বলবে।

>

তদন্তের জন্য বাংলাদেশে দাপ্তরিক কাজ শুরুর নীতিগত সিদ্ধান্ত আইসিসির কৌঁসুলির দপ্তরের আইসিসির উপ-কৌঁসুলি স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ১৬ জুলাই বাংলাদেশে আসছে তদন্তের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের জেনারেলদের বিচারে একধাপ এগিয়ে যাচ্ছে আইসিসি

সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র শুক্রবার সকালে আইসিসি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বাংলাদেশ সফরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, রাখাইনে বড় ধরনের গণহত্যা হয়েছে, এর জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি। কাজটি করতে আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে দলিল–দস্তাবেজ ঠিকঠাক রাখা হয়েছে কি না, সেটা দেখার আছে। পাশাপাশি এতে বৃহৎ শক্তির সমর্থনও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আদালতে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা করলে তাতে বৃহৎ শক্তির সমর্থন লাগবে। ওই সমর্থন ছাড়া আদালতের রায় বাস্তবায়ন কঠিন হবে।

আইসিসি প্রতিনিধিদলের সফর
কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, আইসিসির প্রতিনিধিদলের সফরে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রমের বিষয়ে দুই পক্ষের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সইয়ের বিষয়ে আলোচনা কথা রয়েছে। ওই সমঝোতা স্মারকে দাপ্তরিক কাজের পরিধি, দপ্তর স্থাপন, সাক্ষী সুরক্ষা, আইসিসির প্রতিনিধিদের কূটনৈতিক সুবিধা নিশ্চিতের মতো বিষয়গুলো অর্ন্তভুক্ত রাখার কথা বিবেচনায় আছে।

আইসিসিতে মিয়ানমারের তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান যে দ্বিপক্ষীয়ভাবে হবে না, সেটা শুরু থেকেই বলছি। সে ক্ষেত্রে অন্য যে বিকল্পগুলো আমাদের সামনে আছে, সেগুলোকে কাজে লাগানোর ওপর বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিতে হবে। আমার দেশের স্বার্থে পদক্ষেপ নিলে কে কী মনে করল, তাতে কিছু যায় আসে না। আইসিসির পদক্ষেপে কাজ হোক না হোক, এর সঙ্গে আমাদের থাকতে হবে। কারণ, রোহিঙ্গা নিপীড়নের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের অভিযুক্তদের দায়ী করে আইসিসি যে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলবে, সেটা শেষ পর্যন্ত কতটা কার্যকর হবে সেটা বলা কঠিন। তবে এটি মিয়ানমারকে চাপে ফেলবে।’

রোহিঙ্গাদের ওপর মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে কি না, তা নিয়ে আইনি মত চেয়ে গত বছরের ৯ এপ্রিল প্রাক্-শুনানি আদালতে আবেদন জানান আইসিসির কৌঁসুলি ফেতু বেনসুদা। পরে গত বছরের জুনে আইসিসির অনুরোধে সাড়া দিয়ে এ বিষয়ে পর্যবেক্ষণ পাঠায় বাংলাদেশ। কিন্তু মিয়ানমার আগস্টে জানিয়ে দেয়, আইসিসির এ নিয়ে কাজ করার এখতিয়ার নেই। কারণ, মিয়ানমার রোম সনদে সই করেনি। তাই আইসিসিতে কোনো পর্যবেক্ষণ পাঠাবে না মিয়ানমার।

সর্বশেষ আইসিসির কৌঁসুলি ফেতু বেনসুদা রোহিঙ্গা বিতাড়নের তদন্তে বিচারিক অনুমতি চেয়ে মাত্র গত সপ্তাহেই প্রাক্-শুনানি আদালতের কাছে অনুরোধ জানান। এ জন্য রোহিঙ্গাদের সাক্ষ্য দিতে তিনি ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত সময় চেয়েছেন।

ফেতু বেনসুদা ৪ জুলাই হেগে অবস্থিত আইসিসির প্রাক্-শুনানি আদালতে বলেন, ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়ন শুরু হয়েছিল, সেই সময় থেকে তদন্ত করা হবে। এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে ২০১৭ সালে সহিংসতার মধ্য দিয়ে বিতাড়ন, অন্যান্য অমানবিক কর্মকাণ্ড আর নিপীড়নের মধ্য দিয়ে যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তার ভিত্তি রয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক মনে করেন, রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা আর মানবতাবিরোধী অপরাধ নিয়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আইসিসির বিচারের পদক্ষেপ খুবই ইতিবাচক অগ্রগতি। তিনি গত শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, নিরাপত্তা কাউন্সিলের মতামত ছাড়াই আইসিসি তদন্ত শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তা ছাড়া আইসিসিতে বাংলাদেশ যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছিল, সেটাও আইসিসিকে তদন্তে নামতে সাহায্য করেছে। অনেকেই ভেবেছিল, রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের মধ্য দিয়ে যে নৃশংসতা চালানো হয়েছে, সেটা মানুষ ভুলে যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা হচ্ছে না। আইসিসির এই প্রক্রিয়ায় যেহেতু সময় নেবে। তাই এখনই বলা যাবে না, শেষ পর্যন্ত কী হবে। তবে আইসিসির উদ্যোগের মধ্য দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত রোহিঙ্গারা তাদের কথা বলার সুযোগ পাবে। অনেক অজানা সত্য বের হয়ে আসবে।

আইসিসি যেভাবে বিচার এগিয়ে নেয়
কোথাও গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও অন্য ধরনের আগ্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিচারের জন্য তদন্তে নামে আইসিসির কৌঁসুলির দপ্তর। শুরুতে মাঠপর্যায়ে তথ্যানুসন্ধানে গিয়ে দেখা হয়, তদন্ত চালানোর জন্য যৌক্তিক কারণ বা উপাদান আছে কি না। প্রাথমিকভাবে অভিযোগের বিষয়ে পর্যাপ্ত উপাদান খুঁজে পাওয়ার পর তদন্ত শুরুর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর তদন্ত পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট দেশে একটি প্রতিনিধিদল পাঠানো হয়। আইন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গড়া প্রতিনিধিদলটি নির্দিষ্ট গন্তব্যে গিয়ে ঘটনার শিকার হওয়া লোকজন এবং সাক্ষীদের ভাষ্য নেয়। এসব কাজের ক্ষেত্রে রোম সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্থাসমূহের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সহায়তা নেয় আইসিসি। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে অভিযোগের ব্যাপারে পর্যাপ্ত প্রমাণ পাওয়ার পর কৌঁসুলির দপ্তর বিচারকের কাছে অভিযুক্তদের আদালতে হাজির হওয়া কিংবা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির অনুরোধ জানায়। এরপর আদালতের এখতিয়ার অনুযায়ী অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধ করেছেন—এ বিষয়ে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে বলে বিচারকদের কাছে মনে হলে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।