সব 'অতিদরিদ্র' শুধু আ.লীগে

ফরিদপুরসহ তিন জেলায় দুগ্ধখামার গড়ে তোলার জন্য গাভি কিনতে একটি প্রকল্পের আওতায় বিনা সুদে ঋণ দিচ্ছে সরকার। এই ঋণ পাওয়ার কথা অতিদরিদ্রদের। কিন্তু ফরিদপুর সদর উপজেলার তিনটি ইউনিয়নে এ সুবিধা পাচ্ছেন শুধু আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকেরা। ফলে আর্থিক অবস্থা ভালো, এমন ব্যক্তিরাও অতিদরিদ্রদের ঋণে ভাগ বসিয়েছেন। আবার আওয়ামী লীগের বাইরে কেউ এই ঋণ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে।

সদর উপজেলার চর মাধবদিয়া, নর্থ চ্যানেল ও ডিক্রিরচর ইউনিয়নের দুগ্ধখামারি, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে। দলের স্থানীয় নেতাদের দেওয়া তালিকা ধরেই ঋণ দিচ্ছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা। চর মাধবদিয়া ও নর্থ চ্যানেল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিএনপি–সমর্থিত হওয়ায় তাঁদের ঋণ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা হয়নি। কিন্তু ডিক্রিরচরের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা হওয়ায় তিনি ঋণ পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের তালিকা তৈরির কাজে যুক্ত ছিলেন।

ফরিদপুরের ডিক্রিরচরের ৯টি ওয়ার্ডের ৪৫০ জনের চূড়ান্ত তালিকার (ঋণ পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তি) অনুলিপি প্রথম আলোর কাছে রয়েছে। এতে দেখা যায়, তালিকাটি চূড়ান্ত করেছেন সরকারি দল–সমর্থিত ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, সাবেক চেয়ারম্যান, আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। ডিক্রিরচরের চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, দলের লোকেরাই সব করেছে। তবে তিনি এ কাজে যুক্ত ছিলেন না। পরে চেয়ারম্যান হিসেবে তালিকায় শুধু স্বাক্ষর করেছেন। তাঁর পরিবারের একাধিক সদস্যের (চাচাতো ভাই ও চাচা) নাম ঋণ পাওয়া ব্যক্তিদের তালিকায় থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতারা নাম দিয়েছেন, তিনি কারও নাম দেননি।

‘বৃহত্তর ফরিদপুরের চরাঞ্চল এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন ও দুগ্ধের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিতকরণ কারখানা স্থাপন’ নামের একটি প্রকল্প ২০১৮ সালে চালু করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ৩৪৪ কোটি টাকার এ প্রকল্পের আওতায় অতিদরিদ্রদের ৭২ কোটি টাকার ঋণসহায়তা দেওয়া হচ্ছে। ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা করে মোট ৩ হাজার হতদরিদ্র ব্যক্তি পাচ্ছেন এই ঋণ। ঋণ পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৩৫০ জনই ফরিদপুর সদর উপজেলার। এর বাইরে জেলার বোয়ালমারী ও চরভদ্রাসন, রাজবাড়ী জেলার পাংশা ও গোয়ালন্দ এবং গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া ও কাশিয়ানী উপজেলায় প্রকল্পের আওতায় ঋণ দেওয়া হচ্ছে। নির্ধারিত উপজেলার মনোনীত ইউনিয়নগুলোর প্রতিটি ওয়ার্ডে ৫০ জন অতিদরিদ্র ব্যক্তিকে বাছাই করে সমিতি করা হচ্ছে। সমিতির সদস্যরাই ঋণ পাচ্ছে।

প্রকল্প কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়নের (মিল্ক ভিটা) নিজস্ব সংগঠক দিয়ে ঋণ পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের তালিকা তৈরির কথা। সেটি কেন হয়নি, তা জানতে চাইলে প্রকল্পের পরিচালক মো. আবদুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ফরিদপুরে মিল্ক ভিটার নিজস্ব সংগঠক দিয়েই তালিকা করা হয়েছে। পরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা তা শুধু যাচাই করে দেখেছেন।

>

দুগ্ধখামারের জন্য সরকার একটি প্রকল্পের আওতায় অতিদরিদ্রদের ঋণ দিচ্ছে
ঋণ পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের তালিকা ঠিক করে দিয়েছেন আ.লীগের নেতারা
দলের স্থানীয় নেতাদের দেওয়া তালিকা ধরেই ঋণ দিচ্ছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা

সদর উপজেলার চরমাধবদিয়া ইউনিয়নের খলিল মণ্ডল বাজারের ব্যবসায়ী মো. জাহাঙ্গীর মোল্লাও ‘অতিদরিদ্র’ হিসেবে ঋণসুবিধা পেয়েছেন। অথচ ওই বাজারে ইলেকট্রনিকপণ্য বিক্রির দোকান রয়েছে তাঁর। এ ছাড়া মাইক ভাড়া দেওয়ার দোকানও রয়েছে। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। আবার একই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবদুল আজিজও ঋণ পেয়েছেন। বাজারে তাঁরও একটি দোকান রয়েছে।

চরমাধবদিয়া ইউনিয়নের ব্যবসায়ী এবং ইউপি সদস্যের ঋণ পাওয়ার বিষয়ে প্রকল্পের পরিচালক মো. আবদুল করিম বলেন, ইউপি সদস্য হতদরিদ্র হলে ঋণ পেতে তো কোনো সমস্যা নেই। যাচাই-বাছাই করেই ঋণ দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

তবে চরমাধবদিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি তুহিনুর রহমান মণ্ডল বলেন, সব সমিতি নিজেদের লোক দিয়েই করা হয়েছে। এই ইউনিয়নের বিএনপি–সমর্থিত চেয়ারম্যান মির্জা সাইফুল ইসলাম আজম প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগের বাইরে কারও নাম সমিতির সদস্যের তালিকায় নেওয়া হয়নি।

প্রকল্প অনুযায়ী, মোট ৩ হাজার খামারি দুটি করে ৬ হাজার গাভি কিনবে। ঋণ পাওয়ার ১২ মাস পর থেকে ৩৬ কিস্তিতে তা পরিশোধ করতে হবে। এতে কোনো সুদ নেই, তবে মোট ঋণের ওপর ৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জ দিতে হবে। খামারিদের কাছ থেকে দুধ কিনে নেবে মিল্ক ভিটা। আর সেই দুধের দাম থেকেই কিস্তি পরিশোধিত হবে।

সার্বিক বিষয়ে ফরিদপুরের সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সাবেক সভাপতি মজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নির্দিষ্ট দলের সমর্থক দেখে ঋণ দেওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। যারা ঋণ পাওয়ার যোগ্য, দলমত নির্বিশেষে তাদের ঋণ দেওয়া উচিত।