পাটুরিয়ায় ট্রাক পারাপার: চাঁদা ছাড়া চাকা নড়ে না

মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাট এলাকায় ট্রাফিক পুলিশ ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থার (বিআইডব্লিউটিসি) একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে বেপরোয়া চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছেন পণ্যবাহী ট্রাকচালক ও তাঁদের সহকারীরা। যার প্রভাব পড়ছে দূরপাল্লার যাত্রীবাহী বাস পারাপার ও ঘাটের সার্বিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে।

গুরুত্বপূর্ণ এই নৌপথ দিয়ে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার মানুষ যাতায়াত করে। বিআইডব্লিউটিসির হিসাবে, প্রতিদিন পাটুরিয়া ঘাট দিয়ে আড়াই হাজারের বেশি যানবাহন পার হয়। এর মধ্যে ছোট আকারের যানবাহনের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। পণ্যবাহী ট্রাকের সংখ্যা গড়ে সাড়ে আট শ।

ঘাট এলাকায় দুই দিনের অনুসন্ধানের সময় অন্তত ৭০ জন ট্রাকচালক ও সহকারীর সঙ্গে কথা বলেন প্রথম আলোর দুই প্রতিবেদক। তাঁরা বলছেন, পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিসির কাউন্টারে চাঁদা না দিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, এমনকি গাড়ির চাপ বেশি থাকলে কখনো কখনো এক থেকে দেড় দিন পর্যন্ত টার্মিনালে অপেক্ষা করতে হয়।

সরেজমিন চিত্র
নিয়ম হচ্ছে পণ্যবাহী প্রতিটি ট্রাক প্রথমে ঘাটের উত্তর পাশে স্থাপিত ওজন স্কেলে উঠে ওজন পরিমাপের পর বাঁ পাশের টার্মিনালে ঢুকবে। এরপর টার্মিনালের ভেতরে স্থাপিত কাউন্টারে টাকা জমা দিয়ে ক্রমিক নম্বরে স্লিপ নিয়ে সেখানেই অপেক্ষা করবে। টার্মিনাল থেকে নির্ধারিত ঘাটে যাওয়ার জন্য আলাদা পথ আছে। তাই এই অংশে ট্রাক কখনো মূল সড়কে উঠবে না। তবে বুধবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত টার্মিনালের প্রবেশপথে দাঁড়িয়ে থেকে দেখা যায়, অন্তত ১০টি ট্রাক ওজন স্কেল থেকে নেমে টার্মিনালে না ঢুকে সরাসরি মূল সড়কে উঠে যায়। আবার প্রবেশপথ দিয়ে টার্মিনালের ভেতরে থাকা ১৫ টির মতো ট্রাক নির্ধারিত সারিতে না গিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। প্রবেশপথের সামনেই তখন বেরিয়ে আসা ট্রাকচালকদের সঙ্গে চাঁদার পরিমাণ নিয়ে দর-কষাকষি করছিলেন সহকারী শহর উপপরিদর্শক (এটিএসআই) আবদুর রশিদ ও ট্রাফিক কনস্টেবল মো. জাকারিয়া। পরে সমঝোতার ভিত্তিতে একটি একটি করে ট্রাক ছেড়ে দিচ্ছিলেন তাঁরা।

সক্রিয় দালাল চক্র
ঘাট এলাকায় চাঁদাবাজিতে পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে দালাল চক্র। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরাই ট্রাকচালকদের সঙ্গে পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। বৃহস্পতিবার সকালে ট্রাকচালক ও তাঁদের সহযোগীদের সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানে মতিন নামের এক ব্যক্তি তাঁদের শাসাতে থাকেন। পরে জানা যায়, তিনি ঘাট এলাকার দালাল। সক্রিয় দালালদের মধ্যে আরও আছেন সুকুমার, সোহরাব, জনি, মজনু, বাবুল, রফিক, মতিন প্রমুখ। এ ছাড়া ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বিআইডব্লিউটিসির পাঁচজন কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিআইডব্লিউটিএর একজন পরিদর্শক এবং ট্রাফিক পুলিশের কয়েকজন পরিদর্শকের নামও আছে।

>

গুরুত্বপূর্ণ এই নৌপথ দিয়ে ২১টি জেলার মানুষ যাতায়াত করে
প্রতিদিন পাটুরিয়া ঘাট দিয়ে আড়াই হাজারের বেশি যানবাহন পার হয়
ছোট আকারের যানবাহনের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি
পণ্যবাহী ট্রাকের সংখ্যা গড়ে সাড়ে আট শ
পুলিশ ও বিআইডব্লিউটিসির কাউন্টারে চাঁদা না দিলে টার্মিনালে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়
পাটুরিয়া ঘাটে দৈনিক চার লাখ টাকা চাঁদাবাজি হয়
চাঁদাবাজির অভিযোগে ৫ ট্রাফিক পুলিশের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চলছে

সূত্রমতে, দৈনিক এই ঘাট থেকে আদায় করা চাঁদার পরিমাণ চার লাখ টাকার বেশি। যার ভাগ ট্রাফিক পুলিশের সদস্য থেকে শুরু করে বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্থানীয় শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা ও দালাল সবাই পান। আর এসবই করা হয় ঘাট এলাকায় স্থাপিত সিসিটিভি ক্যামেরা বন্ধ রেখে।

কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
বুধবার সন্ধ্যায় ঘাট এলাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে ছিলেন ট্রাফিক পরিদর্শক রাসেল আরাফাত। ট্রাফিক পুলিশের চাঁদাবাজির অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবে এটা করে থাকে, তাহলে তা আমাদের জানার কথা না।’

পাটুরিয়া ঘাটে চাঁদাবাজি নিয়ে কথা হয় মানিকগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার রিফাত রহমান শামীমের সঙ্গে। তিনি এর সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘আমি নিজে বিআইডব্লিউটিসির কাউন্টার থেকে চাঁদা আদায়ের সময় হাতেনাতে চাঁদাবাজকে ধরেছি। এ ছাড়া চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ট্রাফিক পুলিশের পাঁচ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা চলছে। গত তিন মাসে পরিদর্শক, কনস্টেবলসহ ২৫ জনকে বদলি করা হয়েছে।’

তবে বিআইডব্লিউটিসির আরিচা কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক আজমল হোসেন বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তিনি তদন্ত করে দেখবেন।