সিলেট অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত, দুর্ভোগ

>

কুশিয়ারা নদীর পাড় উপচে রাস্তা ভেঙে পানি ঢুকছে গ্রামে। গতকাল মৌলভীবাজার সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের হামরকোনা সড়কে।  প্রথম আলো
কুশিয়ারা নদীর পাড় উপচে রাস্তা ভেঙে পানি ঢুকছে গ্রামে। গতকাল মৌলভীবাজার সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের হামরকোনা সড়কে। প্রথম আলো

সুনামগঞ্জ-বিশ্বম্ভরপুর ও সুনামগঞ্জ-জামালগঞ্জ সড়ক থেকে পানি নেমে যাওয়ায় যানবাহন চলাচল করছে। 

সুনামগঞ্জের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। বৃষ্টি কম হওয়ায় সুরমা নদীর পানি কিছুটা কমেছে। তবে জেলার নিম্নাঞ্চলের কিছু এলাকায় শনিবার রাতে পানি বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি পানিবন্দী জেলার তাহিরপুর ও বিশ্বম্ভরপুরের পরিস্থিতি কিছুটা উন্নতি হয়েছে। নতুন করে কোনো গ্রাম প্লাবিত না হলেও সিলেটে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত অবস্থায় রয়েছে।

সুনামগঞ্জ পৌর শহরের কাছে সুরমা নদীর পানি গতকাল বেলা তিনটায় বিপৎসীমার ৭৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। শনিবার একই সময় পানি বিপৎসীমার ৮৭ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। গত ২৪ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে ৭৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এর আগের ২৪ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছিল ১৬৬ মিলিমিটার।

সুনামগঞ্জ-বিশ্বম্ভরপুর ও সুনামগঞ্জ-জামালগঞ্জ সড়ক থেকে পানি নেমে যাওয়ায় গতকাল রোববার সকাল থেকে যানবাহন চলাচল করছে। তবে তাহিরপুর উপজেলার সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আছে। শনিবার রাতে নতুন করে জেলার ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার কিছু এলাকা প্লাবিত হয়। ছাতকের জাউয়াবাজার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুরাদ আহমদ জানান, ইউনিয়নের বেশির ভাগ গ্রামই প্লাবিত হয়েছে। মানুষজনের বাড়িঘরে পানি আছে।

গতকাল দুপুরে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার বজ্রনাথপুর, চান্দারগাঁও গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, গ্রামের অধিকাংশ মানুষের বসতঘর থেকে বন্যার পানি নেমেছে। তবে ঘরের ভেতর কাদামাটি জমে থাকায় রান্নাবান্না নিয়ে ভোগান্তিতে আছে লোকজন। চান্দারগাঁও গ্রামের ক্ষীরেন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘গরিব মানুষ। কামকাজ নাই। খেয়ে না-খেয়ে দিন গেছে। চেয়ারম্যান সাব শুধু দেইখা গেছে, কোনো সাহায্য দিছে না।’

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সমীর বিশ্বাস জানান, পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। উপজেলার সাতটি বিদ্যালয়ে বন্যাকবলিত অন্তত ৫০টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল। গতকাল একটি স্কুলে মাত্র তিনটি পরিবার ছিল। অন্যরা ফিরে গেছে। উপজেলায় ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত আছে বলে জানান তিনি।

জগন্নাথপুরে নতুন নতুন এলাকার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। ইউএনও (চলতি দায়িত্বে) ইয়াসির আরাফাত বলেন, চারটি ইউনিয়নের লোকজন পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। বন্যাকবলিত শতাধিক পরিবারের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে।

ধরমপাশায় ভারী বর্ষণের কারণে থেমে থেমে বন্যার পানি বাড়ছে। এ উপজেলার ১৯৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ১১০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। বন্যার পানিতে এ উপজেলার ২৬ হেক্টর আমন বীজতলার মধ্যে চার হেক্টর পানিতে তলিয়ে গেছে। ইউএনও মোহাম্মদ ওবায়দুর রহমান বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের মধ্যে ত্রাণসহায়তা কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

বন্যায় পানিবন্দী একটি পরিবার। সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলার সুখাইড় রাজাপুর উত্তর ইউনিয়নের নূরপুর গ্রামে।  ছবি: প্রথম আলো
বন্যায় পানিবন্দী একটি পরিবার। সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলার সুখাইড় রাজাপুর উত্তর ইউনিয়নের নূরপুর গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত) মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম জানিয়েছেন, জেলার ৫টি উপজেলায় আরও ১১০ মেট্রিক টন চাল ও ১ হাজার ২৫০ প্যাকেট শুকনা খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।

সিলেটের গোয়াইনঘাটে পানি কিছুটা কমলেও অপর সাতটি উপজেলায় পানি এক থেকে দুই ইঞ্চি বেড়েছে। বন্যার্তদের সহায়তায় গতকালও উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ত্রাণসহায়তা দেওয়া হয়েছে।

গতকালও জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢল অব্যাহত ছিল। তাই জেলার প্রধান দুটি নদী সুরমা ও কুশিয়ারার পানি বেড়েছে। জেলার আটটি উপজেলা ছাড়াও সিলেট সিটি করপোরেশনের সুরমা নদীতীরবর্তী এলাকা গতকালও পানিবন্দী ছিল।

প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী জেলার বন্যাকবলিত এলাকার শতাধিক বিদ্যালয়ে পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। প্রায় দুই লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে রয়েছে।

গোয়াইনঘাটের ইউএনও বিশ্বজিৎ কুমার পাল জানান, গতকাল পানি কিছুটা কমেছে। তবে দুই শতাধিক গ্রামের মধ্যে হাওরতীরবর্তী ৫০টি গ্রাম পানিবন্দী রয়েছে। গতকাল তাঁর উপজেলায় ত্রাণসহায়তা হিসেবে ৯ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে।

গত শুক্রবার রাতে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ পৌরসভার রামপাশা এলাকায় প্রতিরক্ষা বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছিল। শনিবার প্রতিরক্ষা বাঁধের আরও দুটি স্থানে ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। এতে ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ৩০০ পরিবার, দেড় শতাধিক ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং শতাধিক হেক্টরের আউশ খেত নিমজ্জিত হয়েছে।

ইউএনও আশেকুল হক বলেন, বন্যার বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন থেকে সার্বক্ষণিক নজরদারি রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ২০০ প্যাকেট খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

এদিকে কুশিয়ারায় পানি বৃদ্ধি পাওযায় মৌলভীবাজার সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। অন্তত পাঁচটি গ্রামের প্রায় আড়াই হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। প্রায় অর্ধশত পরিবার ঘরবাড়ি ছেড়ে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে। মৌলভীবাজারে মনু, ধলাই ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল দুপুরে মৌলভীবাজার-৩ আসনের সাংসদ নেছার আহমদ কুশিয়ারার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। 

পাউবো মৌলভীবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী রনেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী বলেন, সব কটি নদ-নদীতে পানি বাড়ছে। এতে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, প্রতিনিধি, সিলেট, জগন্নাথপুর, ধরমপাশা ও কমলগঞ্জ]