বরিশালে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে ১৫ দিনে ১২ জনের মৃত্যু

বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন জেলায় গত ১৫ দিনে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে অন্তত ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন শ্রমিক, দুজন শিক্ষার্থী, আছেন কৃষক দম্পতিও।

বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতাকে দায়ী করেছেন নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা। তবে বিদ্যুৎ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা এ জন্য মানুষের অসচেতনতা এবং বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ঘেঁষে ঘরবাড়ি নির্মাণ করাকে দায়ী করেছেন।

সর্বশেষ গতকাল রোববার রাতে বরিশাল নগরের সদর রোড এলাকার বেলভিউ মেডিকেল সার্ভিস নামে একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সামনে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা যান সুমন শীল (৩২) নামের এক যুবক। সুমনের বাড়ি ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায়।

সুমনের মা দিপালী রানী শীল বলেন, গতকাল ভোলা থেকে তাঁর চিকিৎসা করানোর জন্য বরিশাল নগরের বেলভিউ মেডিকেল সার্ভিসে চিকিৎসকের চেম্বারে আসেন সুমন। রাতে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রিপোর্ট দেখাতে চিকিৎসকের জন্য চেম্বারের সামনে অপেক্ষমাণ ছিলেন তাঁরা। এ সময় সুমনের সঙ্গে থাকা তাঁর ছেলে সেখানে বসে খেলতে শুরু করে। তখন ছেলেকে শান্ত করার জন্য সুমন সামনের দিকে এগিয়ে যান। এ সময় লোহার একটি কলাপসিবল গেটে হাত লাগামাত্রই সুমন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে গুরুতর আহত হন। কলাপসিবল গেটটি আগে থেকে বিদ্যুতায়িত ছিল। শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর রাত পৌনে একটার দিকে সুমন মারা যান।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুসন্ধান করে জানা যায়, চলতি মাসের ১৫ দিনে বরিশাল বিভাগে অন্তত ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে। এর মধ্যে গত ১২ জুলাই শুক্রবার একদিনেই মারা যান চারজন। এদিন পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জে বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে সাহেব আলী সিকদার (৫০) নামে অপর এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। নিহত শ্রমিকের বাড়ি পার্শ্ববর্তী বরগুনার বেতাগী উপজেলার হোসনাবাদ গ্রামে। গাছ কাটার সময় অসাবধানতাবশত গাছের একটি ডাল বিদ্যুতের তারের সঙ্গে জড়িয়ে গেলে সাহেব আলী মারা যান। একই দিন শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সুরাইয়া জান্নাত (১৮) নামের এক এইচএসসি পরীক্ষার্থী মারা যান। মৃত্যুর ১৬ দিন আগে গৌরনদী পৌর এলাকার চ গাধাতলী মহল্লায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন সুরাইয়া।

১২ জুলাই ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মারা যান মিলন হোসেন (৩৫) নামের এক নির্মাণশ্রমিক। মিলন একটি ভবনের ছাদে কাজ করার সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান। একই দিন নলছিটি উপজেলার বাড়ির ছাদে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান মগড় ইউনিয়ন ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক বিপ্লব খান (২৫)।

এর আগের দিন ১১ জুলাই বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এক কৃষক দম্পতির মৃত্যু হয়। কৃষক কামাল হোসেন (৪০) ও তাঁর স্ত্রী মমতাজ বেগম (৩২) বসতবাড়ি সংলগ্ন পাটখেতে পাট কাটতে গেলে ছিঁড়ে যাওয়া বিদ্যুতের তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান এই দম্পতি।

১০ জুলাই বানারীপাড়া উপজেলা কমপ্লেক্স সংলগ্ন নির্মাণাধীন একটি ভবনের দোতলায় রড তুলতে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে শহিদুল ইসলাম খান (২৩) নামের এক নির্মাণশ্রমিকের মৃত্যু হয়। ৯ জুলাই বরিশাল নগরের রূপাতলী এলাকায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান মাহাতাব হোসেন (৩৫) নামের এক নির্মাণশ্রমিক। ৭ জুলাই ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার ওসমানগঞ্জ ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে প্রাণ হারান এনামুল হক মিয়াজী (৪০)। একই দিনই পটুয়াখালী মির্জাগঞ্জে বিদ্যুতের তার জড়িয়ে কাদের আকন (৮০) নামের এক বৃদ্ধ মারা যান।

এ ছাড়া ৩ জুলাই পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে জামাল হাওলাদার (৪০) নামে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়।

চলতি মাসের ১৫ দিনে এত মানুষের প্রাণহানির ঘটনায় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে অধিকাংশ দুর্ঘটনার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগের উদাসীনতাকে দায়ী করেছেন নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা। বিদ্যুতের সংযোগ তার দ্রুত মেরামত না করায় সাধারণ মানুষ দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ তাঁদের।


এ অভিযোগ অস্বীকার করে বরিশাল পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১–এর মহাব্যবস্থাপক (জিএম) শংকর কুমার কর বলেন, বিদ্যুৎ সম্পর্কে মানুষের সচেতনতার অভাব আছে। এই উদাসীনতা ও অসচেতনতা থেকেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টে দুর্ঘটনা বাড়ছে। তিনি বলেন, যেসব স্থানে আগে বাড়িঘর ছিল সেখান, থেকেই বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন টানা হয়েছিল। এখন সেখানে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছে। যে কারণে ভবনের বারান্দা, ছাদ অথবা চালার ওপরে বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন থাকায় এসব ঘটছে দুর্ঘটনা।

তিনি বলেন, ঝড় কিংবা দুর্যোগে সঞ্চালন লাইন, সংযোগ লাইনের তার ছিঁড়ে পড়বে—এটা স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু এ রকম ঘটনা পর তাৎক্ষণিক কোনো অভিযোগ আসে না। তবে ইতিমধ্যে দেশব্যাপী ইউআরআইডিএস প্রকল্পের মাধ্যমে পল্লী বিদ্যুতের ঝুঁকিপূর্ণ সংযোগ (ঘরবাড়ির ছাদ ও বারান্দাঘেঁষা সংযোগ তার) বিনা খরচে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে করে দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে।