সিলেট নগরে কোমরপানি

সুরমায় পানি বেড়ে যাওয়ায় সিলেট শহরে আটকে থাকা পানি সরছে না। অনেক এলাকায় নদীর পানি উপচে পড়ে প্লাবিত হয়েছে। ছবি: আনিস মাহমুদ
সুরমায় পানি বেড়ে যাওয়ায় সিলেট শহরে আটকে থাকা পানি সরছে না। অনেক এলাকায় নদীর পানি উপচে পড়ে প্লাবিত হয়েছে। ছবি: আনিস মাহমুদ

মহল্লার ভেতর দিয়ে কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ সরু একটি রাস্তা চলে গেছে। সড়কের কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও আবার কোমরপানি। জমে থাকা পানিতে ভাসছে বারোয়ারি ময়লা-আবর্জনা আর পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বোতল ও ককশিট। কালো পানি থেকে উৎকট দুর্গন্ধও ছড়াচ্ছে। দুর্গন্ধযুক্ত পানি মাড়িয়েই স্থানীয় বাসিন্দারা এখন চলাচল করছেন।

চার দিন ধরে এমন অবস্থা চলছে সিলেট নগরের উপশহর সি ব্লক এলাকায়। সুরমা নদীর পানি উপচে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। একই এলাকার ডি–ব্লক মহল্লাতেও অনুরূপ দৃশ্য দেখা গেছে। তবে উপশহর ছাড়াও নগরের কালীঘাট, ছড়ারপাড়, মাছিমপুর, তালতলা, তেরোরতন ও মেন্দিবাগ এলাকার মানুষও একই কারণে পানিবন্দী জীবনযাপন করছেন। এসব এলাকার একাংশ প্লাবিত হয়েছে। প্লাবিত বাসাবাড়িগুলোতে কমবেশি ৩০ হাজার মানুষ বসবাস করছে। বাসাবাড়িতে পানি ঢুকে যাওয়ায় অনেকে ইটের মধ্যে কাঠ ফেলে ঘরের মধ্যে চলাচল করছে। অনেকের রান্নাঘর তলিয়ে যাওয়ায় বাইরে থেকে খাবার কিনে খেতে হচ্ছে।

ভুক্তভোগী নগরবাসীদের কয়েকজন জানিয়েছেন, নগরের প্লাবিত এলাকার পাশ দিয়ে সুরমা নদীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী ছড়া (প্রাকৃতিক খাল) রয়েছে। নদীতে পানি বেশি থাকায় কয়েক দিন ধরে টানা বৃষ্টিপাতের কারণে সৃষ্ট পানি ছড়া দিয়ে নদীতে মিশতে পারছে না। এ অবস্থায় ছড়া ও নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টিপাত না কমলে এমন অবস্থার পুরোপুরি অবসান হবে না বলেও তাঁরা ধারণা করছেন। তবে আগের দিনের তুলনায় পানি গতকাল কয়েক ইঞ্চি পরিমাণ কমেছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।

বেলা পাঁচটার দিকে এক তরুণীকে উপশহর এলাকার সি–ব্লকের রাস্তা দিয়ে পানি মাড়িয়ে আসতে দেখা যায়। পানি মাড়ানোয় হাঁটু পর্যন্ত জামা-প্যান্ট ভিজে আছে। নাসিমা আক্তার নামের ওই তরুণী নগরের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়াশোনা করছেন। নাসিমা জানান, তাঁদের বাসা ও সামনের রাস্তায় চার দিন ধরে পানি জমে থাকায় তিনি এত দিন বাসার বাইরে বেরোননি। গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ থাকায় আজ বাইরে বেরিয়েছেন। পানির কারণে ওই রাস্তা দিয়ে রিকশাসহ সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। তাই তাঁকে হেঁটে পানি মাড়িয়েই আসতে হয়েছে।

শাহজালাল উপশহর এলাকার বিভিন্ন সড়ক ও বাসাবাড়ি পানিবন্দী। ছবিটি আজ সোমবার ‍দুপুরে তোলা। ছবি: আনিস মাহমুদ
শাহজালাল উপশহর এলাকার বিভিন্ন সড়ক ও বাসাবাড়ি পানিবন্দী। ছবিটি আজ সোমবার ‍দুপুরে তোলা। ছবি: আনিস মাহমুদ

আজ সোমবার বিকেলে সরেজমিনে দেখা গেছে, তালতলা এলাকায় গুলশান হোটেল থেকে জামতলামুখী সড়কের একাংশ পানিতে ডুবে আছে। এর আশপাশের বাসাগুলোতে পানি ঢুকেছে। ছড়ারপাড়, মাছিমপুর ও মেন্দিবাগ এলাকায় অন্তত তিন শতাধিক পরিবার পানিবন্দী রয়েছে। উপশহর, তেরোরতন ও কালীঘাট এলাকায় বাসার পাশাপাশি অনেক দোকানপাটেও পানি ঢুকেছে। এ কারণে দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। ছড়ার নিকতবর্তী এলাকা হওয়ায় প্রতিটি এলাকার সৃষ্ট পানিতে ময়লা-আবর্জনা ভাসছে।

মেন্দিবাগ এলাকার গৃহিণী শাহিনা বেগম বলেন, ‘এলাকায় উন্মুক্ত স্থান রয়েছে। সেখানে ঝোঁপ-ঘাস রয়েছে। এখন বন্যার পানি সেসব ঝোঁপ-ঘাসের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। সে পানি বাসা-বাড়িতেও ঢুকেছে। তাই জোঁকের উপদ্রব বেড়েছে। রান্নাঘর তলিয়ে যাওয়ায় বাইরে থেকে আমাদের গত চার দিন ধরে খাবার কিনে এনে খেতে হচ্ছে।’ ছড়ারপার এলাকার বাসিন্দা আখতার মিয়া জানান, সোবহানীঘাট, চালিবন্দর ও ছড়ারপাড় দিয়ে প্রবাহিত ছড়ার চালিবন্দর-সোবহানীঘাট অংশে সংযোগ স্থাপনকারী একটি বাঁশের সেতু রয়েছে। এটিও পানিতে তলিয়ে গেছে। তাই ঝুঁকি নিয়ে এ সেতু দিয়ে কেবল চোখের আন্দাজে স্থানীয়রা পারাপার হচ্ছেন।

কালীঘাট আলী আমজদ রোডে কথা হয় ময়না মিয়া নামের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তিনি জানান, সুরমা নদী ও ছড়াগুলো পানিতে একাকার হয়ে গেছে। ফলে নগরের সকল বর্জ্য ছড়া দিয়ে এসে সুরমা ও ছড়ার মিলনস্থলে আটকে আছে। সেসব ময়লা নদী ও ছড়া তীরবর্তী প্লাবিত এলাকাগুলোর বাসা-বাড়িতেও ঢুকছে। এটিই প্লাবিত লোকজনদের সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে। এ ছাড়া সারাক্ষণ ওই ময়লাযুগ্ধ পানির উৎকট দুর্গন্ধ তো রয়েছেই।

সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুরমা নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় নগরের খাল-ছড়াগুলো দিয়ে বৃষ্টির পানি স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতে পারছে না। নদীর পানি উপচে তীরবর্তী কিছু এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে। তবে নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। একটু রোদ দেখা দিলেই দু-একদিনের মধ্যে পরিস্থিতি পুনরায় স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’

জলমগ্ন সড়ক এভাবেই পার হচ্ছে মানুষ। ছবি: আনিস মাহমুদ
জলমগ্ন সড়ক এভাবেই পার হচ্ছে মানুষ। ছবি: আনিস মাহমুদ