দিন রাত সমান আমার, সবই অন্ধকার...

মোহন সরকারের ৬০ এর কাছাকাছি বয়স। জন্ম থেকেই তিনি দুচোখে দেখেন না। পথে প্রান্তরে গান গেয়ে সংসার চালান মোহন সরকার। আর বাঁশির জাদুতে মুগ্ধ করেন পথের মানুষকে। তবে বয়স বাড়ছে, শরীরটাও ভালো যায় না প্রায় সময়। তাই চিন্তা, আর কত দিন গান গাইতে পারবেন। গান গাইতে না পারলে পরিবারের পাঁচ সদস্যের মুখে খাবার জোটানো কঠিন হয়ে যাবে।

মোহন সরকার বেশির ভাগ সময় জামালপুর, শেরপুরের পথে প্রান্তরে ঘুরে গান করেন। তবে ছোট ছেলের পড়াশোনা, বড় মেয়ে ও ছেলের চাকরির আশায় গাজীপুরের মৌচাকে ঘর ভাড়া নিয়েছেন। গাজীপুর, চৌরাস্তাসহ আশপাশেও গান করেন। একা ঘুরতে পারেন না বলে স্ত্রীকেও পথে প্রান্তরে ঘুরতে হয়।

শনিবার দুপুরে প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে কথা হলো মোহন সরকারের সঙ্গে। এক ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে গাজীপুর থেকে এসেছেন। আবার ফিরতে হবে তাই তাড়া ছিল। গান শুনতে চাইলে গাইলেন-‘দিন রাত সমান আমার, সবই অন্ধকার...’।

মোহন সরকারের এক মেয়ে দুই ছেলে। দুই বছর আগে মেয়ে চট্টগ্রাম মহিলা পলিটেকনিক্যাল থেকে ইলেকট্রনিকস এ ডিপ্লোমা সম্পন্ন করে ঘরে বসে আছেন। মেয়ে চট্টগ্রাম রেলওয়েতে ইন্টার্নিও করেছে। মোহন সরকার টাকার অভাবে মেয়েকে বিএসসিতে ভর্তি করাতে পারছেন না বলে মেয়ে বেশ মনঃক্ষুণ্ন। মোহন সরকারের এক ছেলে এইচএসসি পর্যন্ত পড়েছেন। ছোট ছেলে পড়ছে দশম শ্রেণিতে। আগ্রহের সঙ্গে জানালেন, বড় ছেলে টাইলস মিস্ত্রির কাজ শিখেছে। গলায় আবার হতাশা-ছেলেকে কেউ কাজে ডাকে না।

মোহন সরকার বললেন,‘ মেয়েকে পড়াইয়্যা লাভটা কি হইলো? মেয়ের ইচ্ছা বিএসসি পড়বে। কিন্তু আমার সামর্থ্য নাই। মেয়ে চাকরির জন্য কত জায়গায় সিভি জমা দিল, কিন্তু কেউ চাকরি দেয় না। এখন তো মেয়েরে বিয়াও দিতে পারতেছি না। লেখাপড়া কম ছেলে আসে বিয়ার প্রস্তাব নিয়া। মেয়ের বেশি পড়াশোনা, কেমনে কম লেখাপড়া জানা ছেলের কাছে বিয়া দেই? আমি পড়ছি মহা বিপদে।’

মোহন সরকার। ছবি: মানসুরা হোসাইন
মোহন সরকার। ছবি: মানসুরা হোসাইন

মোহন সরকার আক্ষেপ করে বললেন, কষ্ট করে পড়ালেও ছেলে মেয়ে বরাবরই ভালো ফলাফল করেছে। কিন্তু এখন আর পড়াশোনার খরচ চালাতে পারছেন না। বললেন,‘আমার ইনকামের ঠিক নাই। মাসে গড়ে ১০-১৫ হাজার টাকা পাই। গান শুনাই, কিছু চাই না। মানুষ খুশি হয়ে যা দেয় তাই নিই। গান শুইন্যা কেউ দেয়, কেউ দেয় না। আর এখন অনেকেই গান শুইন্যা মোবাইলে রেকর্ড কইরা নেয়। আর ফেসবুক, ইউটিউবে বিভিন্ন শিল্পীর গানে ভিড়ে পথশিল্পীদের কদরও তো নাই।’

একদম ছোট বয়সে মোহন সরকারের মা মারা যান। মায়ের চেহারা মনে নেই। ঘরে সৎমা আসার পর মোহন সরকারের জীবনটাই পাল্টে যায়। একে চোখে দেখেন না, তার ওপর সৎমায়ের অত্যাচার। সারা দিন সংসারের কাজ করাতেন সৎমা। গরু ছাগল দেখা থেকে শুরু করে বাড়ির কাজের লোকদের দেখভালও করতে হতো মোহন সরকারকে। ঢেঁকিতে ধান থেকে চাল বের করতে হতো। লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। তবে মোহন সরকারের গানের নেশা ছিল ছোট বেলা থেকেই। একটু অবসর পেলেই গ্রামের চাঁন মিয়ার কাছে গিয়ে বাঁশি বাজাতে শিখতেন। স্কুলের মাঠে বসে গান গাইলে বা বাঁশি বাজালে ছাত্ররা টিফিন খাওয়াতো। শিক্ষকেরা আদর করতেন। মোহন তখন থেকেই বুঝতে পারেন গানের সম্মান আছে।

শেরপুরে মোহন সরকারের সম্বল সাড়ে ৭ শতাংশ জমিতে বাড়ি ভিটে। এর বাইরে আর কিছু নেই। ছেলে মেয়েদের পড়াশোনা করানোর জন্য দেড় লাখ টাকা ঋণ করেছেন। গান গেয়েই সে ঋণ শোধ করছেন। এখনো ৭০ হাজার টাকা ঋণ পরিশোধ করা বাকি আছে।

মোহন সরকার বললেন,‘যার ১০ তালা বিল্ডিং আছে সে ২০ তালা বানাইতে চায়। আমি এত কিছু চাই না। আমার মেয়েটার স্বপ্ন ডিসি হওনের। বড় অফিসার হইতে চায়। বিএসসিটা যদি শেষ করতে পারত ওর ইচ্ছাটা পূরণ হইতো। কেউ যদি আমার মেয়েটার পড়াশোনার কিছু খরচ দিত, তাইলে আর কিছু চাইতাম না।’