দুর্গম চরে দুর্বিষহ জীবন

যমুনার দুর্গম চরে পানিবন্দী মানুষ। শেষ সম্বল নিয়ে অজানা ঠিকানায় যাচ্ছেন ফজলু হক ও চিনি বেগম দম্পতি। গতকাল বগুড়ার সারিয়াকান্দির আউচার পাড়া চরে।  ছবি: সোয়েল রানা
যমুনার দুর্গম চরে পানিবন্দী মানুষ। শেষ সম্বল নিয়ে অজানা ঠিকানায় যাচ্ছেন ফজলু হক ও চিনি বেগম দম্পতি। গতকাল বগুড়ার সারিয়াকান্দির আউচার পাড়া চরে। ছবি: সোয়েল রানা

যমুনার ঢলে প্লাবিত লোকালয়। চারদিকে থইথই পানি। বুকসমান পানিতে তলিয়ে গেছে বসতঘর, টইটম্বুর উঠান-বারান্দা, শোবার ঘর। কোথাও বিন্দু পরিমাণ শুকনো জায়গা নেই। ঘরের ভেতর ও বারান্দায় বাঁশের মাচা তৈরি করে সেখানে আশ্রয় নিয়েছে নারী ও শিশুরা। পুরুষেরা আশ্রয় নিয়েছে নৌকায়। ঘরের সঙ্গে চৌকি ঝুলিয়ে সেখানে বসানো হয়েছে রান্নার চুলা। কিন্তু চুলা জ্বালানোর মতো খড়ি নেই কোথাও। নেই রান্না করার চাল-ডাল। ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে ধান-চাল, বিছানা-বালিশ।

এই চিত্র বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের যমুনা নদীর দুর্গম আউচারপাড়া চরের। এই চরে প্রায় ২০টি পরিবারের বসবাস। নৌকায় করে চরের বাসিন্দা মিনারা বেগমের (৭০) বাড়ির উঠানে গিয়ে জানালা দিয়ে দেখা গেল, ঘরের ভেতরে বুকসমান পানি। নারী-পুরুষ মিলে ৯ জন বসতঘরের ভেতরে উঁচু মাচা তৈরি করে আশ্রয় নিয়েছেন। থইথই পানিতে বাড়ি থেকে বের হওয়ার একমাত্র অবলম্বন ডিঙি। চরের অন্য বাসিন্দাদের অবস্থাও মিনারা বেগমের মতো। অনেকের আশ্রয়স্থল এখন নৌকা।

গতকাল একই চিত্র দেখা গেল যমুনা নদীর দুর্গম আরও সাতটি চর ঘুরে। সেগুলো হলো হাটবাড়ি চর, ভাঙ্গুরগাছা চর, সুজনেরপাড়া চর, শিমুলতাইর চর, চর দলিকা, খাটিয়ামারি চর এবং বিরামের পাঁচগাছি চর। এসব চরে তলিয়ে গেছে শত শত নলকূপ। দেখা দিয়েছে খাওয়ার পানির সংকট। নেই পর্যাপ্ত ত্রাণ। নেই আশ্রয়শিবির। নেই চিকিৎসার ব্যবস্থা।

চার দিন ধরে পানিবন্দী আউচারচরের ফজলু হক (৬৫) ও তাঁর স্ত্রী চিনি বেগম (৬০)। বসতবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় একটি বাক্স আর ঘটিবাটি, হাঁড়ি-পাতিল নৌকায় তুলে আশ্রয়ের খোঁজে যাচ্ছিলেন অন্যত্র। ফজলু জানান, বাড়িঘর ডুবে যাওয়ায় রান্না করার শুকনো জায়গা নেই। দুদিন ধরে রান্না হয়নি। এক প্যাকেট বিস্কুট ছিল, তা–ও শেষ। বাধ্য হয়ে আশ্রয়ের খোঁজে নৌকায় ঘুরছেন।

দুটি গরু নিয়ে নৌকার খোঁজে দাঁড়িয়ে ছিলেন মেহের ভানু। তাঁর স্বামী আবদুল আজিজ নৌকা খুঁজতে গেছেন। সন্তান ও গরু নিয়ে তিনি আউচারপাড়ার উঠোনে অপেক্ষা করছেন। তিনি বলেন, ছোট দুই সন্তানের মুখে দুদিন ধরে ভাত তুলে দিতে পারেননি। রান্না করার উপায় নেই। শুকনো খাবার খেয়ে দুদিন চলছে। দুটি গরু নিয়ে আরও বিপাকে পড়েছেন। অপেক্ষায় রয়েছেন নৌকার। নৌকা পেলে গরুগুলোকে উঁচু কোনো আশ্রয়ে নেবেন।

আউচারপাড়ার পূর্ব দিকে সুজনের পাড়া চর। যমুনা ইতিমধ্যে গিলে ফেলেছে এই চরের লোকালয়। এখন রয়েছে ৮ থেকে ১০টি বসতঘর। পাশে একটি মসজিদের আঙিনায় আশ্রয় নিয়েছেন শতাধিক বানভাসি মানুষ। সঙ্গে রয়েছে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি। কেউবা এনেছেন আলমারি, শোকেসসহ বিভিন্ন আসবাব। তাঁদের মধ্যে কারও ঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। কারও ঘর পানিতে তলিয়ে গেছে।

বানভাসি অন্তত ২০ জন জানান, পানিবন্দী এসব চরের বাসিন্দাদের কারও এখন রান্না করার কোনো সুযোগ নেই। তাই শুকনো খাবারের জন্য সবার মধ্যে চলছে হাহাকার। এই চরের চারদিকে যমুনা নদী। পূর্বে জামালপুর জেলা। উত্তরে গাইবান্ধা। সুজনের চর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরের এই দুর্গম চরে বসবাস প্রায় ৫০০ পরিবারের। চরের অধিকাংশ মানুষ যমুনায় মাছ ধরে জীবিকা চালান। অন্তত দুই বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই চরের বসতঘর এখন বুকসমান পানির নিচে। মানুষ আশ্রয় নিয়েছে নৌকায়, টিনের চাল আর বাঁশের উঁচু মাচায়। চরের কোথাও শুকনো জায়গা নেই। নারীরা ছোট ছোট শিশু নিয়ে চারদিকে নদীঘেরা দ্বীপের মতো এই চরে নৌকায়, মাচায় আশ্রয় নিয়েছে। পানির নিচে তলিয়ে গেছে নলকূপ। বানের পানি খেয়েই তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন এখানকার বানভাসিরা।

সিরাজগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

সিরাজগঞ্জ সংবাদদাতা জানান, সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এতে নদীর তীরবর্তী অনেক নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন চরাঞ্চলের মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, গতকাল সোমবার বেলা তিনটায় সিরাজগঞ্জ হার্ড পয়েন্টে পানির পরিমাণ ১৩ দশমিক ৬০ মিটার রেকর্ড করা হয়েছে। বর্তমানে পানি বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে জেলার কাজীপুর, বেলকুচি, শাহজাদপুর, চৌহালি ও সদর উপজেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভেতরে যমুনার তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। পৌর এলাকার পুঠিয়াবাড়ী ও চর মালশাপাড়া এলাকার বেশ কিছু বাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। পানি আরও বাড়লে শহরের দক্ষিণ এলাকা ও উপজেলা সদরের বাঐতারা, বনবাড়ীয়া, মুলিবাড়ী, কাশিয়াহাটা, সদানন্দপুর, বেলকুচি ও কামারখন্দ উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাবে বলে জানায় স্থানীয় ব্যক্তিরা।

ধুনটে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

বগুড়ার ধুনট প্রতিনিধি জানান, বগুড়ার ধুনট উপজেলাতেও যমুনা নদীর পানি বাড়ার ফলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গতকাল সোমবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে পানি বিপৎসীমার ৭৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।