লোভই ঠেলে নিচ্ছে ভূমধ্যসাগরে

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার হাসানকান্দি এলাকার তরুণ হাসান শরীফ ইতালি যেতে মাসখানেক আগে নিজের পাসপোর্ট দালালকে দিয়েছেন। ইতালি পৌঁছার পর দালালকে আট লাখ টাকা দেবে তাঁর পরিবার। এ বছরই তিনি ইতালি যেতে পারবেন, এমন আশ্বাস পেয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, এলাকার কেউ পড়াশোনা করতে চায় না। সবার ইতালি যাওয়ার নেশা আছে।

হাসানের কয়েকজন আত্মীয় ইতালি থাকেন। কোনোরকমে সেখানে পৌঁছাতে পারলে বাকি ব্যবস্থা তাঁরাই করে দেবেন, এই বিশ্বাস রয়েছে তাঁর। দুই বছর আগেও একবার ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, দালালকে টাকা দিয়েও তখন সফল হতে পারেননি। এরপরও মামলা না করার কারণ হিসেবে বললেন, থানা–পুলিশ করলে ইতালি যাওয়ার ‘সুযোগ’ আর আসবে না।

গত মে মাসে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার হওয়া ৬৪ বাংলাদেশির মধ্যে ২৬ জনই মাদারীপুরের বাসিন্দা।

এ বিষয়ে জেলা সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি খান মোহাম্মদ শরীফ বলেন, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঝুঁকি মাথায় রেখেই এখানকার মানুষ প্রবাসী হয়েছে। এখন আগের চেয়ে ঝুঁকি অনেক বেড়েছে। এরপরও সচেতনতার অভাবে অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার প্রবণতা এলাকায় কমেনি।

রাজৈর উপজেলার হাসানকান্দিতে ইতালি মোড় নামের একটি জায়গা রয়েছে। স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, ওই নামকরণের কারণ মোড়ের চারপাশের এলাকা হাসানকান্দি, পশ্চিম হাসানকান্দি, সাতবাড়িয়া এবং সদর উপজেলার শিরখাড়া, কুঁচিয়াবাজার ও রাজারহাট এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়ির কোনো না কোনো সদস্য ইতালি থাকেন। এসব পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো। তাদের দেখে অন্য এলাকার মানুষেরা ইতালি যাওয়ার বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বৈধভাবে মাদারীপুর থেকে বিদেশে গেছেন প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার জন। তাঁরা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কাজ নিয়ে গেছেন। তবে বিএমইটি সূত্র জানায়, বৈধ ওই সংখ্যার বাইরে একই সময়ে অবৈধ পথে মাদারীপুর থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গেছেন আরও প্রায় কয়েক হাজার। বিশেষ করে ইতালি ও গ্রিসে আছেন স্থানীয় অনেকে। যাঁরা ইউরোপে গেছেন, তাঁদের পরিবারের উন্নতির চিত্র বাকিদের ইউরোপ যেতে আগ্রহী করেছে।

>

ইতালি যাওয়ার পথে গত মে মাসে ভূমধ্যসাগরে উদ্ধার হওয়া ৬৪ বাংলাদেশির মধ্যে ২৬ জনই মাদারীপুরের বাসিন্দা।

বিদেশে যেতে আগ্রহীরা মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পরিশ্রম বেশি, আয় কম। আর ইউরোপে পরিশ্রমের তুলনায় আয় বেশি। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ ছুটছেন সবাই। দালালের খপ্পরে পড়ে একাধিকবার আর্থিক লোকসানের পরও স্থানীয় যুবকদের থামানো যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬ সালের জরিপের (খানার আয় ও ব্যয়) তথ্য অনুযায়ী, দেশে দারিদ্র্যের হার গড়ে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ হলেও মাদারীপুরে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। সে হিসাবে মাদারীপুর দেশের তৃতীয় ধনী জেলা। এ জেলায় তেমন কোনো শিল্পকারখানা নেই। প্রবাসীদের আয়েই এখানকার মানুষের জীবনমানের উন্নতি হয়েছে বলে মনে করেন মাদারীপুর চেম্বারের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি বাবুল চন্দ্র দাস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২০ বছর আগে থেকেই বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা শুরু হয়। তাঁদের অনেকের সচ্ছলতা এখন অন্যদের ঝুঁকি নিতে উৎসাহী করেছে।

সদর উপজেলার বাসিন্দা মিলন মীর ২০০২ সালে ভারত, পাকিস্তান, দুবাই, ইরান, তুরস্ক হয়ে গ্রিসে পৌঁছান। শেষ গন্তব্যে পৌঁছাতে তাঁর সময় লাগে ৫ বছর। ওই সব দেশে একাধিকবার পুলিশের হাতে ধরা পড়েছেন, কারাগারেও গেছেন। ১০ বছর পর ২০১৭ সালে গ্রিস থেকে দেশে ফিরে এখন ব্যবসা করছেন। মিলন মীর বলেন, লোভে পড়ে ঝুঁকি জেনেও সবাই ইউরোপ যেতে চায়। তাঁর বড় ভাই দেলোয়ার মীর ২০১১ সালে রওনা দিয়ে দুই বছর পর ইতালি পৌঁছান, এখন সেখানেই আছেন।

মাদারীপুর কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭–এর ফেব্রুয়ারি থেকে গত মে পর্যন্ত ২২ হাজার কর্মী এ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বিদেশে গেছেন। টিটিসির অধ্যক্ষ মো. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, বৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার সুযোগ নেই। তাই অনেকে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে না এসে গোপনে দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তাদের সচেতন করে তোলা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

সার্বিক বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এলাকায় ধনী হওয়ার একটা প্রতিযোগিতা আছে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও বিবেচনাবোধের অভাবেই অনেকে ঝুঁকি নিচ্ছেন।