বানের পানিতে ভাসছে যমুনার চর

ঘরের ভেতর বুকপানি। পানিতে থইথই করছে উঠান, বারান্দা। আঙিনায় বইছে স্রোত। পানিতে ভিজে গেছে চাল-ডাল, বিছানা-বালিশ। পানিবন্দী ঘর থেকে ভেজা কাপড়ে বের হয়ে এলেন কোহিনূর বেগম। হাতের ওপর তিন বছরের শিশুকন্যা সালমা। ঘরের বাইরে ডিঙি নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করছেন স্বামী আবদুল মোমিন। নৌকায় ঘটি, বাটি, বিছানা, বালিশ। যমুনার পানিতে তলিয়ে যাওয়া বসতঘরে পাঁচ দিন ধরে বন্দী থাকার পর ডিঙি নৌকায় স্ত্রী-কন্যাকে তুলে ছোটেন আশ্রয়ের খোঁজে অন্যত্র।

পানিবন্দী মোমিন-কোহিনূর দম্পতির এই দুর্ভোগের চিত্র দেখা গেল গতকাল সোমবার দুপুরে যমুনা নদীর দুর্গম হাটবাড়িচরে।

হাটবাড়িচরের চারদিকে যমুনা নদী। অনেকটা দ্বীপের মতো এই চর। পূর্বে জামালপুর জেলা। উত্তরে গাইবান্ধা। বগুড়া জেলা শহর থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটার দুরে যমুনা নদীবেষ্টিত এই চরে বসবাস প্রায় সাড়ে চার হাজার মানুষের। ৪০০ পরিবারের বেশির ভাগ মানুষের জীবিকা চলে যমুনায় মাছ ধরে। অন্তত দুই বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই চরের অধিকাংশ বসতঘর এখন যমুনার পানিতে তলিয়ে গেছে বুকসমান পানির নিচে। মানুষ আশ্রয় নিয়েছে নৌকায়, টিনের চাল আর বাঁশের উঁচু মাচায়। চরের কোথাও শুকনো জায়গা নেই। নারীরা ছোট ছোট শিশুকে নিয়ে নৌকায়, মাচায় আশ্রয় নিয়েছেন। তলিয়ে গেছে নলকূপ। নদীর পানি খেয়ে তৃষ্ণা মেটাচ্ছে বানভাসিরা।

আবদুল মোমিন বলেন, ‘যমুনার ঢলে চার দিন ধরে পানিবন্দী। ঘরের ভেতরে বাঁশের মাচা ফেলে স্ত্রী-কন্যা নিয়ে তিন রাত কাটিয়েছি। চুলা জ্বলে না। ঘরে খাবার নেই। ঠান্ডা পানিতে থাকা যায় না।’ এই চরের বাসিন্দা আবদুল খালেক সারা বছর নদীতে মাছ ধরে জীবিকা চালান। তিনি বলেন, ‘১০ দিন ধরে নদী ফুঁসে উঠেছে। মাছ মিলছে না। বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে নৌকায় সংসার পেতেছি। চাল-ডাল যা ছিল সব শেষ। দুদিন ধরে বিস্কুট খেয়ে ক্ষুধা মিটাতে হচ্ছে।’

এই চরের বাসিন্দা জেলে জাহিদুল ইসলামের বাড়ি পানিতে ডুবেছে সাত দিন আগে। ঘরের চালের তিরের সঙ্গে চৌকি ঝুলিয়ে সেখানে রাতে পরিবারের ছয়জন সদস্য মিলে থাকেন। তবে বাড়িতে রান্না করার মতো অবস্থা নেই। দিনের বেলায় পরিবারের লোকজন নিয়ে তিনি নৌকার ওপর দিন কাটান। জাহিদুল বললেন, ‘ভাত রান্না করার অভাবে খাওয়া হচ্ছে না। খাওয়ার পানিও নেই। ত্রাণের ১৫ কেজি চাল পেয়েছি। কিন্তু সবখানেই পানি। রান্না করার উপায় নেই।’

দুপুরের দিকে হাটবাড়িচরে ত্রাণের চাল নিয়ে একটি নৌকা পৌঁছায়। মাথাপিছু ১৫ কেজি করে চালের জন্য তালিকা করা হয়েছে ১৫০ জনের। কিন্তু ত্রাণের নৌকা ঘিরে ধরে কয়েক শ বানভাসি মানুষ।

ত্রাণ বিতরণ শেষে চালুয়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, এই ইউনিয়নে ১১টি চর যমুনার ঢলে প্লাবিত হয়েছে। দুর্গত মানুষের সংখ্যা কয়েক হাজার। অথচ এখন পর্যন্ত ত্রাণ বরাদ্দ মিলেছে ৩০০ প্যাকেট শুকনো খাবার এবং ৫ মেট্রিক টন চাল। দুর্গত মানুষের জন্য এই মুহূর্তে প্রচুর শুকনো খাবারের প্যাকেট প্রয়োজন।

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতিবর্ষণে যমুনা নদীর পানি এখন বিপৎসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনার ঢলে তলিয়ে গেছে অন্তত ১০ হাজার হেক্টর জমির পাটসহ আবাদি ফসল। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় ৬৮ হাজার মানুষ। আজ মঙ্গলবার পর্যন্ত সরকারি হিসাবে দুর্গত এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ১৭ হাজার ৫০০। পানি ঢুকে পড়ায় ৬৫ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

যমুনা নদীর পানি বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার মথুরাপাড়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৯৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছে বানভাসি মানুষেরা। ছবি: সোয়েল রানা
যমুনা নদীর পানি বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার মথুরাপাড়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৯৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছে বানভাসি মানুষেরা। ছবি: সোয়েল রানা

সবচেয়ে বেশি অবনতি ঘটেছে সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলার নদীতীরবর্তী নিম্নাঞ্চল এবং দুর্গম চরে। দুর্ভোগে পড়েছে চর এলাকার হাজার হাজার মানুষ। পানিতে তলিয়ে গেছে বসতবাড়ি। তলিয়ে গেছে পাট, ধানসহ বহু ফসল। দুর্গত এলাকার লোকজন ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ে।

বগুড়া পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, যমুনা নদীর সারিয়াকান্দি পয়েন্টে বিপৎসীমা ধরা হয় ১৬ দশমিক ৭০ সেন্টিমিটার। গতকাল দুপুর ১২টায় পানি ছিল ১৭ দশমিক ৫৭ সেন্টিমিটার। ২৪ ঘণ্টায় পানি বৃদ্ধি পেয়ে আজ দুপুর ১২টায় তা ১৮ সেন্টিমিটার অতিক্রম করেছে।

যমুনার ঢলে সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ি, হাটশেরপুর, কাজলা, কর্নিবাড়ি, বোহাইল, চন্দনবাইশা, কামালপুর ও কুতুবপুর ইউনিয়ন এবং সোনাতলা উপজেলার পাকুল্যা ও তেকানীচুকাইনগর ইউনিয়নের ১০০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে পাট, আউশ ধানসহ বিস্তীর্ণ ফসলের খেত। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছে সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের চরভাঙ্গুরগাছা, চরদলিকা, চরবিরামের পাচগাছি, চরআউচারপাড়া, চরখাটিয়ামারি, সুজনেরপাড়া, বহুলাডাঙ্গা, শিমুলতাইর, ফাজিলপুর, মানিকদাইড়, হাটবাড়ি, হাটশেরপুর ইউনিয়নের চরচকনতিনাথ, দীঘাপাড়া, কাজলাচরের উত্তর ও দক্ষিণ বেণুপুর, জামথৈল, টেংরাকুড়া, পাকদহ, পাকুরিয়া, ঘাঘুয়ারচর, কর্নিবাড়ি ইউনিয়নের মূলবাড়ি, তালতলা, নান্দিনারচর ও বানিয়াপাড়াচরের বানভাসি মানুষ।

যমুনার ঢলে প্লাবিত হয়েছে সারিয়াকান্দি উপজেলার কামালপুর ইউনিয়নের রোহদহ, ইছামারা, চন্দনবাইশা, নিজচন্দনবাইশা, ঘুঘুমারি, দক্ষিণ ঘুঘুমারি শেখপাড়া, ফকিরপাড়া, আকন্দপাড়া, শাকদহ, তালুকদারপাড়ার কয়েক শ বসতবাড়ি। এসব গ্রামের পানিবন্দী মানুষ মালামাল, গরু-বাছুর নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে।

বগুড়া জেলা বন্যা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সূত্রে জানা গেছে, আজ পর্যন্ত জেলার সোনাতলা, সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের ৯৯ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে দুর্গত এলাকার ১৭ হাজার ৫০০ পরিবারের ৬৮ হাজার ৫০০ মানুষ দুর্ভোগে পড়েছে। বন্যায় প্রায় ৪০০ বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানি যত বাড়ছে, পানিবন্দী মানুষের দুর্ভোগ তত বাড়ছে। তলিয়ে গেছে পাট, ধানসহ বহু ফসল।

বগুড়া জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা (ডিআরআরও) আজহার আলী মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় আজ পর্যন্ত দুর্গত ব্যক্তিদের জন্য ৬০০ মেট্রিক টন চাল, ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, নগদ ১০ লাখ টাকা এবং আশ্রয়শিবিরের ৫০০টি তাঁবু বরাদ্দ মিলেছে।