ঘুষ নিয়েছেন দুদক পরিচালক এনামুল বাছির

এনামুল বাছির
এনামুল বাছির

দুদকের মামলা থেকে বাঁচিয়ে দিতে পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মিজানুর রহমানের কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির। দুদকের অনুসন্ধানে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাই মিজান ও বাছিরের বিরুদ্ধে মামলা করেছে সংস্থাটি।

দুদকের সচিব দিলোয়ার বখত আজ মঙ্গলবার বিকেলে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান। তিনি বলেন, আজই ওই দুজনের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দেয় কমিশন। বিকেলে সংস্থার ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১-এ মামলাটি করেন সংস্থার পরিচালক ফানাফিল্লাহ।

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, খন্দকার এনামুল বাছির কমিশনের দায়িত্ব পালনকালে অসৎ উদ্দেশ্যে নিজে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার আশায় ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। অভিযোগ, ডিআইজি মিজানুর রহমানকে অবৈধ সুযোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর অবৈধভাবে অর্জিত ৪০ লাখ টাকা ঘুষ হিসেবে নিয়েছেন। ঘুষের ওই টাকার অবস্থান গোপন করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি দণ্ডবিধির ১৬১ ধারা তৎসহ দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারা এবং মানিলন্ডারিং আইন ২০১২-এর ৪(২) (৩) ধারায় অপরাধ করেছেন।

একইভাবে ডিআইজি মো. মিজানুর রহমান সরকারি কর্মকর্তা হয়েও তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার আশায় অর্থাৎ অনুসন্ধানের ফলাফল নিজের পক্ষে নেওয়ার অসৎ উদ্দেশ্যে খন্দকার এনামুল বাছিরকে অবৈধভাবে প্রভাবিত করেছেন। এ জন্য ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে পরস্পর যোগসাজশে দণ্ডবিধির ১৬৫ (ক) ধারা তৎসহ দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারা এবং মানিলন্ডারিং আইন ২০১২-এর ৪(২) (৩) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

এজাহারে আরও বলা হয়, ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর ডিআইজি মিজানের অবৈধ সম্পদ অর্জনসংক্রান্ত একটি অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় এনামুল বাছিরকে। ওই অনুসন্ধান চলমান অবস্থায় গত ৯ জুন ডিআইজি মিজান ওই অনুসন্ধান থেকে বাঁচতে এনামুল বাছিরকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর আসে। এর পরপরই দুদকের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি তাৎক্ষণিকভাবে খন্দকার এনামুল বাছিরের বক্তব্য গ্রহণ করে এবং পারিপার্শ্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে ঘুষ নেওয়ার বিষয়ে প্রাথমিক সত্যতা পায়। এরপর ১৩ জুন পরিচালক ফানাফিল্লাহর নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধান দল গঠন করে।

অনুসন্ধান দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন, ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য গ্রহণ, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণ ও পারিপার্শ্বিক বিষয়াদি পর্যালোচনা করে। তাতে দেখা গেছে, চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি ডিআইজি মিজানুর রহমান একটি বাজারের ব্যাগে করে কিছু বইসহ ২৫ লাখ টাকা খন্দকার এনামুল বাছিরকে দেওয়ার জন্য রাজধানীর রমনা পার্কে আসেন। সেখানে কথাবার্তা শেষে একসঙ্গে বেরিয়ে শাহজাহানপুর এলাকায় যান। এরপর খন্দকার এনামুল বাছির ২৫ লাখ টাকাসহ ব্যাগটি নিয়ে তাঁর বাসার দিকে চলে যান। একইভাবে ২৫ ফেব্রুয়ারি ডিআইজি মিজান একটি শপিং ব্যাগে করে ১৫ লাখ টাকা নিয়ে রমনা পার্ক যান। সেখানে আলাপ আলোচনা শেষে দুজন শান্তিনগর এলাকায় চলে যান। শান্তিনগরে এনামুল বাছির ব্যাগটি নিয়ে চলে যান। দুদকের কাছে এ ঘটনার প্রযুক্তিগত প্রমাণের পাশাপাশি চাক্ষুষ সাক্ষীও রয়েছে।

এজাহারে দুদক আরও বলেছে, এনামুল বাছির ও মিজানের কথোপকথন পর্যালোচনায় তারা দেখেছে, বাছির তার ছেলেকে কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল থেকে আনা-নেওয়ার জন্য ডিআইজি মিজানুর রহমানের কাছে একটি গাড়িও দাবি করেন। বিষয়টি তিনি দুদকের বিভাগীয় তদন্ত কমিটির কাছে স্বীকার করেন বলে এজাহারে বলা হয়েছে।

অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, ডিআইজি মিজান ও বাছির দুজনই বেআইনিভাবে দুটি পৃথক সিম ব্যবহার করে একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। ওই সিম দুটি ডিআইজি মিজানের দেহরক্ষী মো. হৃদয় হাসান ও আরদালি মো. সাদ্দাম হোসেনের নামে কেনা। সিমের সঙ্গে বাছিরকে একটি স্যামসাং মোবাইল সেটাও কিনে দেন মিজান। ওই দুটি নম্বরের মাধ্যমে মিজান ও বাছির নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন। দুদক বলছে, ডিআইজি মিজান অসৎ উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে ঘুষ লেনদেন সংক্রান্ত কথোপকথন রেকর্ড করে সংরক্ষণ করেছেন এবং পরে সেগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।

দুদকের অনুসন্ধান দল বলেছে, অনুসন্ধানকালে বিশেষজ্ঞ মতামত, প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের বক্তব্য, অডিও রেকর্ডে উভয়ের কথোপকথন ও পারিপার্শ্বিক বিষয় পর্যালোচনা করে প্রমাণ হয়েছে, নিজে অভিযোগের দায় থেকে বাঁচার জন্য ডিআইজি মিজানুর রহমান অসৎ উদ্দেশ্যে ঘুষ নিতে এনামুল বাছিরকে প্রভাবিত করেছেন।

অনুসন্ধানপ্রক্রিয়া
ডিআইজি মিজানের সরবরাহ করা অডিও রেকর্ডের সূত্র ধরে দুদকের পরিচালককে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দেওয়ার তথ্য একাধিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ডিআইজি মিজানও এ বিষয়ে নিজেই ওই সব গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দেন। অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা থেকে বাঁচতে ওই অর্থ ঘুষ দেন বলে মিজান দাবি করেন। এরই ধারাবাহিকতায় দুদক ঘুষের বিষয়টি অনুসন্ধান করতে পরিচালক ফানাফিল্লাহর নেতৃত্বে একটি অনুসন্ধান দল গঠন করে। সাময়িক বরখাস্ত করা হয় এনামুল বাছিরকে। এর মধ্যে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মিজানের বিরুদ্ধে মামলা করেন পরিচালক মঞ্জুর মোর্শেদ। ওই মামলায় জামিনের জন্য আদালতে গেলে মিজানকে কারাগারে পাঠান আদালত।

দুদকের অনুসন্ধানসংক্রান্ত একাধিক সূত্র বলছে, এনামুল বাছির ঘুষ নিয়েছেন, এটা অডিও রেকর্ডে প্রমাণ আছে। আর ডিআইজি মিজান নিজেই ঘুষ দেওয়ার কথা প্রকাশ্যে বলে নিজের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিজেই প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সূত্রের তথ্যমতে, এনটিএমসির বিশেষজ্ঞ দল সময় নিয়ে ওই কথোপকথন ছাড়াও এ-সংক্রান্ত পারিপার্শ্বিক অন্যান্য বিষয় পরীক্ষা করে দেখেছে। তাদের মধ্যে কতবার কথা হয়েছে, কোথায় কোন টাওয়ারের অধীনে কথা হয়েছে, দুদকের মামলা থেকে রেহাই পেতে ডিআইজি মিজান কী কী করেছেন, অনুসন্ধান কর্মকর্তার সঙ্গে একান্ত বৈঠকে কী কী বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন, তাঁরা কতবার এসএমএস বিনিময় করেছেন ইত্যাদিও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

এনটিএমসির প্রতিবেদন পাওয়ার পর ৪০ লাখ টাকার ঘুষ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকার প্রাথমিক সত্যতা পেয়ে বাছিরের দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা চাওয়া হয়। গত ২৬ জুন বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ পরিদর্শককে (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছিল ‘অভিযোগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি পরিচালক (সাময়িক বরখাস্তকৃত) খন্দকার এনামুল বাছিরের বিরুদ্ধে ঘুষ লেনদেন ও মানিলন্ডারিং-সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগের সত্যতা দুদকের প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হওয়ায় বিদেশ গমন রহিত করা একান্ত আবশ্যক।’

অনুসন্ধানকালে দুদক অভিযোগসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। গতকাল সোমবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটে ডিআইজি মিজানুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদকের অনুসন্ধান দল। আদালতের আদেশ নিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
এর আগে ডিআইজি মিজানের অফিসের আর্দালি সুমনকে ২৬ জুন, দেহরক্ষী হৃদয় হাসান ও গাড়িচালক সাদ্দাম হোসেনকে ৭ জুলাই জিজ্ঞাসাবাদ করে অনুসন্ধান দল। অন্যদিকে এনামুল বাছিরকে ১০ জুলাই দ্বিতীয় দফায় তলব করা হলেও তিনি হাজির না হয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে দুদকে লিখিত বক্তব্য জমা দেন।

অন্যদিকে এনামুল বাছির দুদকে যে বক্তব্য জমা দিয়েছেন, তাতে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন। তাঁর অভিযোগ, যে প্রক্রিয়ার ফরেনসিক পরীক্ষা করা হয়েছে, তা যথাযথ নয়। এ ছাড়া পরীক্ষার জন্য তাঁর কোনো ‘স্যাম্পল ভয়েস’ নেওয়া হয়নি বলেও উল্লেখ করেন বাছির। তাঁর দাবি, তাঁকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানো হয়েছে।

যার জন্য ঘুষ তাতেও আসামি মিজান
এদিকে যে অনুসন্ধানের তথ্য ধামাচাপা দিয়ে মামলা থেকে রেহাই পাওয়ার আশায় ঘুষ দিয়েছেন বলে ডিআইজি মিজান দাবি করেছেন, সে ঘটনায় মামলা হয়েছে। গত ২৪ জুন করা ওই মামলায় ৩ কোটি ৭ লাখ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন এবং ৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা অবৈধ সম্পদের অভিযোগ আনা হয়। মামলায় মিজান ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন মিজানুর রহমানের স্ত্রী সোহেলিয়া আনার রত্না, ভাগনে পুলিশের এসআই মাহমুদুল হাসান ও ছোট ভাই মাহবুবুর রহমান।