কাঠগড়ায় 'রাজীব গান্ধী' ও 'র‍্যাশ'কে শনাক্ত করল সাক্ষী

হোলি আর্টিজান
হোলি আর্টিজান

হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা মামলায় গ্রেপ্তার দুই আসামিকে শনাক্ত করেছে তানভীর কাদেরী ও আবেদাতুন ফাতেমা আশার দশম শ্রেণিপড়ুয়া কিশোর সন্তান। এই প্রথম মামলাটিতে কোনো সাক্ষী আসামি শনাক্ত করে সাক্ষ্য দিল। আজ মঙ্গলবার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে তার সাক্ষ্যটি ছিল বেশ দীর্ঘ।

যে দুই আসামিকে কাঠগড়ায় কিশোরটি শনাক্ত করে, তাঁরা হলেন আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে র‍্যাশ ও জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী। গুলশানের হোলি আর্টিজানে হামলার মূল পরিকল্পক তামিম চৌধুরীসহ শীর্ষস্থানীয় সব জঙ্গি এবং হামলায় অংশগ্রহণকারী পাঁচ তরুণের তাদের বাসায় যাতায়াতের কথা সে আদালতকে বিস্তারিতভাবে জানায়। একপর্যায়ে আদালত জানতে চান, কিশোরটি যাঁদের কথা বলছে, তাঁদের কেউ কাঠগড়ায় আছেন কি না। জবাবে সে বলে, ‘সাদা শার্ট পরা ‘র‍্যাশ আঙ্কেল’ এবং ‘জাহাঙ্গীর আঙ্কেলের গায়ে লেভিসের টি–শার্ট।’ কাঠগড়ায় থাকা দুই আসামি এ সময় চুপ করে যান।

পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনায় কমপক্ষে ২১ জনের সম্পৃক্ততার কথা বলে। তানভীর কাদেরী তাঁদের একজন। তাঁকে পুলিশ এই হামলায় অর্থদাতা ও আশ্রয়দাতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আজিমপুরে ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর পুলিশি অভিযানের সময় তানভীর কাদেরী আত্মঘাতী হন। সে সময় মা আবেদাতুনের সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছিল কিশোরটি। তার যমজ ভাই আশকোনার সূর্য ভিলায় অপর এক পুলিশি অভিযানে নিহত হয়।

কিশোর জানায়, উত্তরার বাসায় মা–বাবা ও তারা দুই ভাই থাকত। ২০১৪ সালে তানভীর কাদেরী হজ করে আসেন। এরপর প্রতিদিন তিনি লাইফ স্কুলে ফজরের নামাজ পড়তে যেতেন। নামাজ শেষে মুসা ও মেজর জাহিদের সঙ্গে জগিং করতেন। কিছুদিন যাওয়ার পর স্ত্রী আবেদাতুন হিজরত করতে যাবেন কি না, জানতে চান তানভীর কাদেরী। আবেদাতুন রাজি ছিলেন না। পরে তানভীর তাঁকে রাজি করান। তখন তানভীর তাঁর দুই ছেলেকে ডেকে বলেন, ‘আমরা এক জায়গায় যাব, যেখানে খাওয়াদাওয়ার কষ্ট হবে, স্কুল–খেলার মাঠ না–ও থাকতে পারে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা খুশি হবেন।’ এর কয়েক দিন পরই তাদের বাসায় মেজর জাহিদ ও আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে র‍্যাশ আসে। আলাপ–আলোচনার পর তানভীর কাদেরী তাদের বলেন, ‘তোমরা আস্তে আস্তে ব্যাগ গোছাও। আমরা হিজরত করব।’ তারপর তিনি আত্মীয়স্বজনকে জানান, তাঁরা মালয়েশিয়া চলে যাচ্ছেন। থিতু হয়ে সবার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন।

উত্তরা থেকে কিশোর তার বাবা–মায়ের সঙ্গে মিরপুর, বসুন্ধরা, মিরপুর ও আজিমপুর যায়। প্রতিটি বাসাতেই আসলাম আসে। সে আদালতকে জানায়, বসুন্ধরার বাসায় ‘চকলেট আঙ্কেল’ (বাশারুজ্জামান চকলেট) প্রথমে তিনজন ও পরে দুজনকে নিয়ে আসে। তার দিন তিনেক পর তাদের বাসায় এসে ওঠে তামিম, মারজান ও জাহাঙ্গীর। তামিমকে তারা ‘ব্যাটম্যান আঙ্কেল’ বলে ডাকত। তাঁর ঘরে ঢোকা নিষেধ ছিল। জাহাঙ্গীর আলম বসুন্ধরার বাসায় স্ত্রী–ছেলেসহ উঠেছিলেন। সে বলেছে, তামিম ও মারজান হামলাকারীদের নিয়ে বসুন্ধরার সব থেকে বড় কক্ষে থাকত। জাহাঙ্গীরের স্ত্রী থাকতেন আবেদাতুন ফাতেমা আশার সঙ্গে। সে তার বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে এক কক্ষে থাকত। একদিন তামিমের কক্ষে ইফতার দিতে গিয়ে সে সিরিশ কাগজ দিয়ে একজনকে চাপাতি ধার করতে দেখে।

হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার দিনের ঘটনা সম্পর্কে কিশোরটি বলেছে, পাঁচজনের মধ্যে তিনজন প্রথমে ও পরে আরও দুজন বের হয়। যাওয়ার সময় বলে, জান্নাতে গিয়ে তাদের দেখা হবে। ওই দিনই তারা তামিম চৌধুরীর নির্দেশে বাসা ছেড়ে মিরপুরের পল্লবীর আরিফাবাদে চলে আসে।

সাক্ষ্য শেষে আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে র‍্যাশের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ ও জাহাঙ্গীর আলমের আইনজীবী সিতারা ফওজিয়া সালাম জিজ্ঞাসাবাদ করেন। কিশোরটি অপর একটি মামলায় আসামি এবং ওই মামলায় সে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। ফারুক আহম্মেদ ওই মামলায় তার আসামি থাকার প্রসঙ্গ তোলেন। আদালত ফারুক আহম্মেদকে প্রাসঙ্গিক জেরা করতে বলেন। এর কিছুক্ষণ পরই ফারুক আহম্মেদ আসামিদের পক্ষে মামলা না লড়ার আবেদন জানান।

কাঠগড়ায় থাকা আসামি শরিফুল ইসলাম বলেন, তাঁদের আইনজীবী নেই। মামলার কার্যক্রম যেন স্থগিত করা হয়। আদালত তাঁদের বলেন, স্বজনদের ডেকে আইনজীবী চূড়ান্ত করুন। নইলে রাষ্ট্র তাঁদের জন্য আইনজীবী নিয়োগ দেবেন। এই বলে তিনি আদালতের কার্যক্রম আধা ঘণ্টার জন্য মুলতবি করেন।

মঙ্গলবার আরও সাক্ষ্য দেন ১ জুলাই রাতে হোলি আর্টিজানে জিম্মি থাকা ফাইরুজ মালিহা। তিনি বলেন, ঘটনার রাতে তাঁরা লনে বসে আইসক্রিম খাচ্ছিলেন। সন্ত্রাসীরা রেস্তোরাঁয় ঢুকেই এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। তাদের দিকেও একজন লম্বা করে জঙ্গি (নিবরাস বলে পরে জানতে পারেন) বন্দুক তাক করেন। বাঙালি ও মুসলমান এই পরিচয় জানতে পেরে বলেন, তাঁদের কোনো ভয় নেই। পরে তাঁদের রেস্তোরাঁর ভেতরে নিয়ে গিয়ে বসানো হয়। তিনি বলেন গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরও একজন বেঁচে ছিলেন ও গোঙাচ্ছিলেন। রোহান ইমতিয়াজ পরে তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করেন। পরদিন ভোরে এই রোহানই তাঁদের বন্ধু তাহমিদের হাতে অস্ত্র ধরিয়ে দেয়। তাহমিদ সে সময় কাঁদছিলেন এবং বলছিলেন, ‘তোমরা তো আগে বললে আমাদের কোনো ক্ষতি করবে না।’ রোহান জবাবে বলে, অস্ত্রের ভেতর গুলি নেই। তাদের নির্দেশে হাসনাত করিম চাবি দিয়ে রেস্তোরাঁর ফটক খোলেন। তাঁরা প্রথমে নারীদের ও পরে পুরুষদের বেরিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

২৩ জুলাই পরবর্তী শুনানির দিন আসামিপক্ষের আইনজীবী ফাইরুজ মালিহাকে জেরা করতে পারবেন বলে জানান আদালত। হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা মামলার ২৯তম কার্যদিবস ছিল মঙ্গলবার। এই মামলায় আটজন গ্রেপ্তার আছেন। ২০১৬ সালের ২ জুলাই যৌথ বাহিনীর অভিযানে হামলাকারী পাঁচজন নিহত হন। পরে বিভিন্ন অভিযানে নিহত হন আটজন। বাকি আটজন আসামি আদালতের কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন।